ইসলামে নারীর সাজসজ্জা
ইসলাম নারীকে বৈধ সাজসজ্জা করতে বাধা দেয় না। বরং বিবাহিত নারীকে তার স্বামীর নিকট সুসজ্জিত ও পরিপাটি হয়ে থাকার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে অবৈধ সাজসজ্জা তাই, যা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করে, মানব আকৃতি ও ছূরতের পরিবর্তন ঘটায় এবং মানবচক্ষুকে প্রতারিত করে। কেননা ধোঁকাবাজির কোন স্থান ইসলামে নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে কেবল নারীকে আহবান করে। বস্ত্ততঃ তারা কেবল অবাধ্য শয়তানের পূজা করে। আল্লাহ তাকে অভিসম্পাত করেছেন। আর সে বলেছিল যে, অবশ্যই আমি তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে একটা নির্দিষ্ট অংশকে আমার দলে টেনে নিব। আমি অবশ্যই তাদের পথভ্রষ্ট করব, তাদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দিব, তাদেরকে আদেশ দিব যেন তারা পশুর কর্ণ ছেদন করে এবং তাদেরকে আদেশ করব যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করে। যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, সে প্রকাশ্য ক্ষতিতে পতিত হয়’ (নিসা ৪/১১৭-১১৯)।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হ’ল, আজকাল কৃত্রিম রূপচর্চা মুসলিম মহিলা অঙ্গনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পার্লার ব্যবসার নামে এই মহামারী শহরের অলি-গলি পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ধর্মীয় বিধি-বিধানের প্রতি উদাসীন এমন নারীগণ ‘পার্লার সংস্কৃতি’কে হাল ফ্যাশনের প্রতীকরূপে চিহ্নিত করে। অথচ এসব পার্লারগুলো রূপচর্চার আড়ালে শরী‘আত লংঘন করছে এবং অশ্লীলতার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আলোচ্য নিবন্ধে নিষিদ্ধ সাজসজ্জা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
সাজসজ্জার প্রকার : ব্যবহারগত দিক থেকে সাজসজ্জা তিন প্রকার। যথা- ক. মুবাহ সাজসজ্জা, খ. মুস্তাহাব সাজসজ্জা, গ. হারাম সাজসজ্জা।
ক. মুবাহ বা বৈধ সাজসজ্জা : এটা এমন সাজসজ্জা যা শরী‘আতে বৈধ এবং করার ব্যাপারে শরী‘আত নারীকে অনুমতি প্রদান করেছে। এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে যথাযোগ্য স্থানে তথা স্বামী ও মাহরামের নিকটে নারীর সৌন্দর্যের প্রকাশ, রেশমী বস্ত্র ও অলংকার পরিধান, আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার ইত্যাদি। এই মুবাহ বা বৈধ সাজসজ্জাকারী ছওয়াব পায় না এবং এটা পরিহার করার কারণে সে গোনাহগারও হয় না।
খ. মুস্তাহাব সাজসজ্জা : এটা এমন সাজসজ্জা যা করতে শরী‘আতে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। এ পর্যায়ের সাজসজ্জার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত অভ্যাসগত সুন্নাত সমূহ। যেমন গোফ খাটো করা, দাড়ি ছেড়ে দেওয়া, মিসওয়াক করা, (ওযূর সময়) নাকে পানি দিয়ে নাক ঝাড়া, নখ ছোট করা, আঙ্গুলের মাঝে খিলাল করা, বগলের লোম উপড়ানো, নাভীর নীচের লোম কাটা, পানি দ্বারা সৌচকার্য সম্পাদন করা ইত্যাদি।
মুস্তাহাব বলতে বুঝায় যা করলে নেকী আছে। কিন্তু তা ত্যাগ করলে শাস্তি হবে না।
গ. হারাম সাজসজ্জা : এটা এমন সাজসজ্জা যা শরী‘আতে নিষিদ্ধ, যার ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। যেমন ভ্রূ উপড়ানো, নকল চুল লাগানো, পুরুষ ও কাফিরদের সাদৃশ্যপূর্ণ পোষাক পরিধান করা ইত্যাদি। হারাম হচ্ছে যা করলে শাস্তি দেওয়া হয় এবং শরী‘আতের নির্দেশ পালনার্থে তা ত্যাগ করলে নেকী অর্জিত হয়।
সাজসজ্জা ও অপচয় : ইসলাম মধ্যপন্থী জীবন ব্যবস্থা। জীবনের সর্বক্ষেত্রে মধ্যপন্থী হওয়াকে ইসলাম পসন্দ করে। যুবতীরা সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য বর্ধক কাজ করতে পছন্দ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে মধ্যপন্থী ও মিতব্যয়ী হওয়া জরূরী। যারা অপচয় না করে পানাহার ও পরিচ্ছদ গ্রহণ করে তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন- ‘তারা যখন ব্যয় করে, তখন অপব্যয় করে না বা কৃপণতা করে না। বরং তারা এতদুভয়ের মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকে’ (ফুরক্বান ২৫/৬৭)।
রাসূল বলেন ‘তোমরা পানাহার করো, পোষাক পরিধান করো এবং দান-খয়রাত করো অপচয় না করে এবং অহংকার মুক্ত হয়ে’। ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন ‘যা ইচ্ছা খাও ও পরিধান কর, তবে যেন দু’টি জিনিস তোমাকে ত্রুটিযুক্ত না করে- অপচয় ও অহংকার’।
সুতরাং পরিমিত খরচের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় বৈধ সাজসজ্জা করা মুসলিম নারীদের জন্য কর্তব্য। কিন্তু এসব সাজসজ্জায় অহংকার যুক্ত হ’লে তা হারাম হয়ে যাবে।
সাজসজ্জার উদ্দেশ্য : মুসলিম নারীদের যাবতীয় সাজসজ্জা ও শোভা-সৌন্দর্য স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্যই হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামীর নিকটে ব্যতীত’ (নূর ২৪/৩১)। রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল ‘কোন নারী উত্তম? তিনি উত্তরে বললেন, যে স্বামীকে আনন্দিত করে যখন সে (স্বামী) তার দিকে তাকায়’। অপর একটি হাদীছে এসেছে, মু‘আবিয়া আল-কুশাইরী হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের লজ্জাস্থানের কতখানি ঢেকে রাখবো, আর কতখানি খুলে রাখবো? তিনি বলেন, তোমার লজ্জাস্থান আপন স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া অন্যদের থেকে হেফাযত করবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার অভিমত কী যে, লোকেরা যদি একত্রে বসবাস করে? তিনি বলেন, যদি তুমি তা কাউকে না দেখিয়ে পারো, তবে অবশ্যই তা দেখাবে না। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কেউ যদি নির্জনে থাকে? তিনি বললেন, আল্লাহ অধিক অগ্রগণ্য যে, মানুষের চেয়ে তাঁর প্রতি বেশি লজ্জাশীল হবে’। উপরোক্ত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, নারীরা স্বামীকে খুশি করার জন্য নিজে সুসজ্জিত হবে এবং নিজের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলবে।
শরী‘আতের সীমার মধ্যে থেকে নারী যে কোন প্রসাধনী কেবল স্বামীর মন আকর্ষণের জন্য ব্যবহার করতে পারে। তার সামনে পরিধান করতে পারে যে কোন পোষাক, কেবল তার মনোরঞ্জনের জন্য। এই সাজসজ্জাতেও লুকিয়ে থাকে ভালোবাসার রহস্য। পক্ষান্তরে স্ত্রী যদি স্বামীর জন্য অঙ্গসজ্জা না করে; বরং বাইরে গেলে বা অন্য কারো জন্য প্রসাধনী ব্যবহার করে, তবে নিশ্চয়ই সে নারী স্বামীর প্রেম-ভালোবাসার বিরোধী। নতুবা সে স্বামীর প্রেম ও দৃষ্টি আকর্ষণকে যরূরী মনে করে না। এমন নারী হতভাগী বৈ কি? সে জানে না যে, তার নিজের দোষে স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে।
সাজসজ্জার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় : সাজসজ্জার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তাতে যেন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দৃশ্যমান না হয় বরং পূর্ণরূপে সমস্ত দেহ আবৃত থাকে। তদ্রূপ পোষাক যেন আঁটসাঁট ও কাফিরদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ না হয়। সেই সাথে পোষাকে যাতে বিভিন্ন ধরনের ছবি-মূর্তি অঙ্কিত না থাকে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রসাধনীতে যেন হারাম ও ক্ষতিকর কিছু মিশ্রিত না থাকে।
নিষিদ্ধ সাজসজ্জা : মহিলাদের জন্য যেসব সাজসজ্জা নিষিদ্ধ তন্মধ্যে কতিপয় নিম্নে উল্লেখ করা হ’ল।-
১. নগ্ন বা অর্ধনগ্ন হওয়া : নগ্ন-অর্ধনগ্ন হয়ে বাড়ীর বাইরে ঘোরাফিরা করা মুসলিম নারীদের জন্য জায়েয নয়। আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে। প্রাচীন জাহেলী যুগের ন্যায় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়ো না’ (আহযাব ৩৩/৩৩)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আর তুমি মুমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের হেফাযত করে। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তবে যেটুকু স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় সেটুকু ব্যতীত। আর তারা যেন তাদের মাথার কাপড় বক্ষদেশের উপর রাখে’ (নূর ২৪/৩১)।
২. আঁটসাঁট পোষাক পরা : পোষাক-পরিচ্ছদের উদ্দেশ্য হ’ল আবৃত করা। যা লজ্জাস্থান, সতর ও নারীদের সৌন্দর্যের স্থানগুলি ঢেকে রাখার জন্যই পরিধান করা হয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন- ‘হে আদম সন্তান! আমরা তোমাদের উপর পোষাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি বেশভূষার উপকরণ সমূহ’ (আ‘রাফ ৭/২৬)। এই উদ্দেশ্য ঢিলাঢালা ও পুরু পোষাক ব্যতীত পূরণ করা সম্ভব হয় না। কারণ আঁটসাঁট ও পাতলা পোষাকে শরীরের বিভিন্ন আকর্ষণীয় অঙ্গ স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হয়। তাই এ ধরনের পোষাক পরিধান করা মুসলিম নারীদের জন্য জায়েয নয়। যদিও তা মাহরাম পুরুষ এবং কোন মহিলার সামনেও হয়। কেননা মহিলা তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বর্ণনা নিজ স্বামীর কাছে পেশ করবে। মহিলাদের সর্বাঙ্গ ঢেকে চলার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আর তারা যেন তাদের মাথার কাপড় বক্ষদেশের উপর রাখে’ (নূর ২৪/৩১)। সুতরাং যে পোষাকে সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়, তা পরিহার করতে হবে।
উল্লেখ্য, টাইটফিট পোশাক কেবল স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে বাড়ির অভ্যন্তরে পরিধান করা বৈধ। কিন্তু কোন এগানা ও মহিলার সামনে, পিতা-মাতা বা সন্তানদের সামনেও তা ব্যবহার উচিত নয়। তদ্রূপ কেবল স্বামীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অন্তরবাস ব্যবহার করা বৈধ। অন্যকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করা অবৈধ।
স্ক্যার্ট-ব্লাউজ বা স্ক্যার্ট-গেঞ্জি মুসলিম মহিলার পোষাক নয়। বাড়িতেও এগানার সামনে এমন পোষাক পরিধান করা উচিত যাতে গলা থেকে পায়ের গিঁট পর্যন্ত আবৃত থাকে। প্যান্ট-শার্ট মুসলিম নারীদের পোষাক নয়। মহিলারা তা ব্যবহার করতে পারে না, যদিও তা ঢিলেঢালা হয় এবং টাইটফিট না হয়। কারণ এগুলো পুরুষদের পোষাক। আর পুরুষের বেশধারিণী নারী অভিশপ্ত।
৩. পুরুষ ও কাফিরদের সাদৃশ্যপূর্ণ পোষাক পরা : মুসলিম মহিলারা তাদের জন্য নির্ধারিত পোষাক পরিধান করবে এটাই তাদের জন্য সমীচীন। পুরুষদের সাদৃশ্যপূর্ণ পোষাক পরিধানকারী নারীদের রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অভিসম্পাত করেছেন। আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) সেই পুরুষের ওপর অভিশাপ করেছেন যে মহিলার পোষাক পরিধান করে এবং সে মহিলার উপর অভিশাপ করেছেন যে পুরুষের পোষাক পরিধান করে’। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নবী করীম (ছাঃ) ঐসব পুরুষকে লা’নত করেছেন যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে’।
৪. খ্যাতির পোষাক পরা : আল্লাহ তা‘আলা সুন্দর। তিনি সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতা পসন্দ করেন। কিন্তু এতে সময় ও অর্থের অপচয় করা বৈধ নয়। কারণ আল্লাহ অপব্যয়কারীকে পসন্দ করেন না। আর অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। পক্ষান্তরে ফুলের সৌরভ ও রূপের গৌরব থাকেও না চিরদিন। এটা সবাইকে স্মরণ রাখতে হবে। বর্তমানে সুনাম-সুখ্যাতি ও প্রসিদ্ধি লাভের জন্য অনেকে বিভিন্ন পোষাক পরিধান করে। এই ব্যাপারে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে খ্যাতির পোষাক পরিধান করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার কাপড় পরিধান করাবেন। অতঃপর তাতে আগুন প্রজ্বলিত করা হবে’।
৫. পোষাকে ছবি-মূর্তি অঙ্কিত না থাকা : যেসব পোষাকে বা অলঙ্কারে কোন মানুষ বা জীব-জন্তুর ছবি অঙ্কিত থাকে তা ব্যবহার করা বৈধ নয়। যেহেতু ইসলাম ছবি ও মূর্তির ঘোর বিরোধী। অনুরূপভাবে যে পোষাকে বা অলঙ্কারে ক্রুশ, শঙ্খ, সর্প বা অন্যান্য কোন বিজাতীয় ধর্মীয় প্রতীক অঙ্কিত বা খোদিত থাকে, মুসলিমের জন্য তাও ব্যবহার করা বৈধ নয়।
৬. সুগন্ধি ব্যবহার করা : মহিলাদের সুগন্ধি ব্যবহার করে বাড়ীর বাইরে যাওয়া নিষেধ। রাসূল (ছাঃ) বলেন ‘যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করল অতঃপর লোকদের পাশ দিয়ে এ উদ্দেশ্যে অতিক্রম করল যে, তারা যেন তার সুঘ্রাণ পায়, তাহ’লে সে ব্যভিচারী’।
স্বামীর জন্য নিজেকে সর্বদা সুরভিত করে রাখায় নারীত্বের সার্থকতা আছে। ভালোবাসায় যাতে ঘুণ না ধরে; বরং তা যাতে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় ও গভীরতর হয় সে চেষ্টা স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই করা উচিত। এজন্য নারীদেরকে সুগন্ধি বা সেন্টজাতীয় কিছু স্বামীর জন্য বাড়ীর অভ্যন্তরে ব্যবহার করা বৈধ। কিন্তু তা মেখে বাড়ীর বাইরে ও বেগানার সামনে যাওয়া যাবে না। কারণ সুগন্ধি যেমন স্বামীর হৃদয় আকর্ষণ করে সুপ্ত কামনা জাগ্রত করে, তেমনি পরপুরুষের মন আকৃষ্ট করে ও তার কামনাকে প্রবল করে।
৭. ভ্রূ প্লাক করা : পার্লারে ভ্রূ প্লাক করতে যাওয়া নারীর সংখ্যা এখন অনেক বেশী। অনেক মহিলাই মনে করেন ভ্রূ প্লাক করলে তাদের অধিক সুন্দর দেখা যায়। কিন্তু সৌন্দর্যের মানসে ভ্রূ উৎপাটন করা যে গোনাহের কাজ, তা অনেকেই জানে না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন, ‘আমি (শয়তান) তাদেরকে আদেশ করব যেন তারা আল্লাহর সৃষ্টি পরিবর্তন করে’ (নিসা ৪/১১৯)। যারা ভ্রূ প্লাক করে এবং প্লাক করিয়ে নেয় তাদের উভয়কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অভিসম্পাত বা লা‘নত করেছেন।
স্বামী চাইলেও ভ্রূ চেঁছে সরু করে সৌন্দর্য আনয়ন করা বৈধ নয়। কারণ এতে আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন করা হয়। যারা এরূপ করে সে নারীদেরকে নবী করীম (ছাঃ) অভিশাপ করেছেন। অনুরূপভাবে কপাল চেঁছেও সৌন্দর্য আনয়ন করা অবৈধ।
উল্লেখ্য, যদি কারো ভ্রূ বেশী হয় এবং চোখ পর্যন্ত নেমে আসে, দৃষ্টির উপর প্রভাব ফেলে, তবে যে পরিমাণ তার সমস্যা সৃষ্টি করে সেই পরিমাণ কেটে ফেলাতে কোন দোষ নেই। এছাড়া নারীদের মুখমন্ডলে হরমোন জনিত কারণে পুরুষের ন্যায় দাড়ি-গোঁফ বা অস্বাভাবিক লোম উঠলে, তা তুলে ফেলা বৈধ।
উল্লেখ্য, অনেক নারীই স্বামীকে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে ভ্রূ প্লাক করা, চোখের পাতায় কৃত্রিম ল্যাশ লাগানো প্রভৃতিকে জায়েয মনে করে কিন্তু এটা ঠিক নয়। যদি স্বামীকে সন্তুষ্ট করার জন্য আল্লাহর অবাধ্য হওয়া যেত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পবিত্র যবানীতে তা অবশ্যই নিঃসৃত হ’ত। বরং তিনি বলেছেন, ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোনরূপ আনুগত্য নেই। নিশ্চয়ই আনুগত্য হ’ল কেবল ন্যায় কাজে’।
৮. পরচুলা লাগানো : বিয়ে উপলক্ষে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে চুলের গোছা ভারী বা দীর্ঘ দেখানোর জন্য অথবা টাক ঢেকে রাখার জন্য নকল চুল লাগানো হয়। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য পরচুলা লাগানো হারাম। কেননা তা প্রতারণার শামিল। শরী‘আতের একটি অন্যতম মূলনীতি হ’ল, যে ব্যক্তি পাপকাজে সহয়তা করবে সে পাপে লিপ্ত ব্যক্তির ন্যায় সমান পাপী হবে। রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা লা‘নত করেন সেসব নারীদেরকে যারা নিজে পরচুলা লাগায় এবং যারা অন্যদের লাগিয়ে দেয়’।
জনৈক মহিলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমার এক মেয়ের বসন্ত রোগ হয়ে মাথার চুল পড়ে গেছে। আমি তাকে বিয়ে দিয়েছি। তার মাথায় কি পরচুলা লাগাব? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘যে নিজে পরচুলা লাগায় এবং যে তা লাগিয়ে দেয় তাদের উভয়ের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত’।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, কোন এক আনছার মহিলা তার মেয়েকে বিয়ে দিলেন। কিন্তু তার মাথার চুলগুলো উঠে যেতে লাগালো। এরপর সে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট এসে এ ঘটনা বর্ণনা করে বলল, তার স্বামী আমাকে বলেছে যে, আমি যেন আমার মেয়ের মাথায় কৃত্রিম চুল লাগিয়ে দেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘না, তা কর না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা এ ধরনের নারীদের উপর লা‘নত বর্ষণ করেন, যারা মাথায় কৃত্রিম চুল লাগায়’।
হুমাইদ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ) বলেন, আমি যে বছর হজ্জ করেছি, সে বছরই মু‘আবিয়া (রাঃ)-কে মিম্বরে ভাষণ দিতে দেখেছি। তিনি তার একজন রক্ষীর হাত থেকে এক গোছা পরচুলা হাতে নিয়ে বললেন, ‘হে মদীনাবাসী! তোমাদের আলেমগণ কোথায়? আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে এসব জিনিস ব্যবহার করতে নিষেধ করতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, বনী ইসরাঈল তখনই ধ্বংস হয়েছে, যখন তাদের নারীরা এ ধরনের জিনিস ব্যবহার করা শুরু করেছে’।
৯. বিভিন্ন প্রসাধনী, অঙ্গরাগ ও অলঙ্কার : চোখের পাতায় অতিরিক্ত ল্যাশ বা লোম লাগানো বৈধ নয়। কারণ তা পরচুলার সাদৃশ্য বহন করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী অনুযায়ী এধরনের প্রসাধনী ব্যবহারকারিণী রমণী অভিশপ্ত।
স্বামীর দৃষ্টি ও মন আকর্ষণের জন্য ঠোট-পালিশ, গাল-পালিশ প্রভৃতি অঙ্গরাগ ব্যবহার বৈধ যদি তাতে কোন প্রকার হারাম বা ক্ষতিকর পদার্থ মিশ্রিত না থাকে।
নখ কেটে ফেলা মানুষের এক প্রকৃতিগত রীতি। প্রতি সপ্তাহে একবার না পারলেও ৪০ দিনের ভিতর কেটে ফেলতে হয়। কিন্তু এই প্রকৃতির বিরোধিতা করে কতক মহিলা নখ লম্বা করে, যাতে সৌন্দর্য আছে বলে তারা মনে করে। নিছক পাশ্চাত্যের নারীদের অনুকরণে লম্বা নখে নেইল পালিশ লাগিয়ে বন্য সুন্দরী সাজে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করে, সে সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত’।
নেইল পালিশ ব্যবহার বৈধ নয়, কারণ এতে ওযূর অঙ্গে পানি প্রবেশ করে না। এরপরও যদি ব্যবহার করে তবে ওযূর পূর্বে তা তুলে ফেলতে হবে। নচেৎ ওযূ হবে না। এজন্য উত্তম সময় হ’ল মাসিকের কয়েক দিন। তবে মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য ফরয গোসলের পূর্বে অবশ্যই তা তুলে ফেলতে হবে।
মহিলাদের চুলে, হাতে ও পায়ে মেহেদী ব্যবহার করা বৈধ। বরং মহিলাদের নখ সর্বদা মেহেদী দ্বারা রাঙ্গিয়ে রাখাই উত্তম। মেহেদীতে পানি আটকায় না। সুতরাং তা না তুলে ওযূ-গোসল হয়ে যাবে।
পায়ে বাজনা বিহীন নুপুর পরা বৈধ। বাজনা থাকলে বাইরে যাওয়া বা বেগানার সামনে শব্দ করে চলা হারাম। শুধু স্বামী বা এগানার সামনে বাজনা ওয়ালা নুপুর ব্যবহার করা যায়।
অতিরিক্ত উঁচু সরু হিল জুতা পরা বৈধ নয়। কারণ এতে নারীর চলনে দৃষ্টি আকর্ষক ভঙ্গিমা সৃষ্টি হয়, যাতে পুরুষ প্রলুব্ধ হয়।
১০. উল্কি বা ট্যাটু আঁকা : চামড়ায় ধারালো সরু কাঠি, হাড় বা সূচ ফুটিয়ে দিয়ে তাতে রং ঢেলে স্থায়ীভাবে নক্সা আঁকাকে উল্কি উৎকীর্ণ বলে। জাহেলী যুগে লোকজন এই পদ্ধতিতেই দেহে উল্কি উৎকীর্ণ করত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, (সুন্দরতর বস্ত্ততে) বদনযর লাগা একটি ধ্রুব সত্য বিষয়। তাই তিনি উল্কি অঙ্কণ করতে নিষেধ করেছেন। তিনি নিষেধ করেছেন রক্ত ও কুকুরের মূল্য নিতে এবং লা’নত করেছেন সূদ গ্রহীতা, সূদ দাতা, উল্কি অঙ্কনকারী, উল্কি গ্রহণকারী নারীদের প্রতি।
১১. ত্বক ফর্সাকরণ : ত্বকের রঙ কালো বা ফর্সা হওয়া মেলালিনের উপর নির্ভর করে, যা মহান আল্লাহর সৃষ্টি। যিনি আমাদের রিযিক দিচ্ছেন, লালন-পালন করছেন, বেঁচে থাকার জন্য প্রতিমুহূর্তে অক্সিজেন দিচ্ছেন, যিনি আমাদের প্রতিমুহূর্তে অগণিত নে‘মতে ডুবিয়ে রেখেছেন, সে রব প্রদত্ত রং ও আকৃতিতে বান্দা নাখোশ হয় কি করে? আল্লাহর সৃষ্টিতে সন্তুষ্ট থাকাই কৃতজ্ঞ বান্দার পরিচয়। এক্ষণে স্বীয় রবের সৃষ্টিতে অসন্তুষ্ট হয়ে লেজার ট্রিটমেন্ট বা স্কীন ট্রান্সফরমেশনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ত্বকের রং পরিবর্তন করা অর্থাৎ কালো ত্বককে ফর্সা করা বৈধ নয়। কারণ তা আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে, যেভাবে উল্কি অংকন ও দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করার মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টিকে পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু যদি ত্বক মূলত শুভ্র ছিল, পরে অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে নিষ্প্রভ হয়ে যায় সেক্ষেত্রে মেডিসিনের মাধ্যমে প্রকৃত রং ফিরে পাওয়া দোষণীয় নয়।
১২. কাফিরদের অনুকরণে চুল কাঁটা : দীঘল চুলেই নারীদের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুঁটে উঠে। নারীদের জন্য চুল কামানো বা ন্যাড়া করা নিষিদ্ধ। নারীগণ চুল কাটতে পারবে কি-না এ প্রশ্নের উত্তরে শাইখ বিন বায (রহঃ) বলেন, ‘স্বামীর পসন্দও রুচিসম্মত হ’লে চুলের দৈর্ঘ্য কমানো দোষণীয় নয়’। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হ’ল (১) পুরুষদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া যাবে না। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা পুরুষের সাথে মহিলার এবং মহিলার সাথে পুরুষের সাদৃশ্য পোষণকারীকে অভিসম্পাত করেছেন’। (২) অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া যাবে না। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের অন্তর্ভুক্ত’। যেমন- ‘ডায়েনা’ স্টাইলে চুল কাঁটা, খৃষ্টানদের মত ববকাট চুল রাখা ইত্যাদি। আর পশুর আকৃতিতে চুল কর্তন করা নিষিদ্ধ। এছাড়া চুলের কিছু অংশ কেঁটে ফেলতে এবং কিছু অংশ রেখে দিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিষেধ করেছেন।
১৩. কালো কলপ ব্যবহার করা : নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য কালো কলপ ব্যবহার করা নিষেধ। যারা কালো কলপ ব্যবহার করবে তারা জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। কালো কলপ ব্যতীত যেকোন রং ব্যবহার করা যাবে।
পরিশেষে বলব, একজন নারী খুব সহজেই তার চিন্তা, অভিরুচি, মননশীলতা, রুচিশীলতা ও নান্দনিকতা তার পরিবার থেকে ধীরে ধীরে জাতীয় জীবনে ছড়িয়ে দিতে পারে। আজকের নারীসমাজ যদি স্বর্ণযুগের মুসলিম মহিলাদের দিকে দৃষ্টিপাত করে, তবে দেখতে পাবে তারা সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় নয় বরং তাক্বওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলেন। ‘কে কার চেয়ে বেশী সুন্দরী’ এসব ঠুনকো বিষয়ে মাথা না খাটিয়ে, ইসলামের পথে কিভাবে আত্মনিয়োগ করা যায় তারা সেকথা ভাবতেন। আমরা কি পারি না হকের পথে চলতে? আল্লাহর নিকট রং, রূপ, আকৃতি, অর্থ-বিত্ত, বৈভব এসব কোন কিছুই প্রণিধানযোগ্য নয়। তাঁর নিকট ঐ ব্যক্তিই সম্মানিত, যিনি তাক্বওয়ায় সবার চেয়ে অগ্রগামী (হুজুরাত ৪৯/১৩)। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর নির্দেশিত পথে চলার তাওফীক দিন-আমীন!
সৌজন্যে: মাসিক আত – তাহরীক
নিউজ টুডে বিডি/নিউজ ডেস্ক