
পাকিস্তানের আকাশে অমিমাংসিত এক রহস্য
আজ থেকে ৩৭ বছর আগে ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউল হক তার বিশেষ বিমান পাক–১ এ উঠেছিলেন। সেসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের বেশিরভাগ কর্মকর্তাই তার সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু আকাশে ওঠার মাত্র কয়েক মিনিট পরেই বিমানটি ভেঙে পড়ল। মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সামরিক নেতৃত্ব। একই সঙ্গে প্রাণ হারালেন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান দূত আর্নল্ড লুইস রাফায়েল এবং মার্কিন সামরিক মিশনের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হারবার্ট এম. ওয়াসোম।
তিন দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু এই বিমান দুর্ঘটনা আজও রহস্যাবৃত। এটি কি কেবল একটি দুর্ঘটনা, নাকি গভীর ষড়যন্ত্র?
জিয়ার উত্তরাধিকার: পাকিস্তানের ‘ইসলামি বোমা’
১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮—এক দশক ক্ষমতায় থেকে জিয়া পাকিস্তানকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি প্রায় পূর্ণতা পাওয়া।
ভারত যখন ১৯৭৪ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালাল, তখন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা দিয়েছিলেন:
“আমরা ঘাস খেয়ে হলেও নিজেদের বোমা বানাব।”
তার যুক্তি ছিল—খ্রিস্টান বোমা আছে, ইহুদি বোমা আছে, হিন্দু বোমাও হলো, তবে মুসলমানদের কেন থাকবে না?
জিয়া সেই অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ঘোষণা দেন পাকিস্তান এখন “বোমা বানানোর মাত্র এক স্ক্রু-ড্রাইভার দূরে।” পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান সফলভাবে পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে বিশ্বের সপ্তম পরমাণু শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কূটনীতির দাবায় জিয়ার চাল
জিয়ার কূটনীতি ছিল অনিশ্চিত কিন্তু বিচক্ষণ। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদীনদের সমর্থনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে টানেন। প্রথমে অনাগ্রহী আমেরিকাকে তিনি রাজি করান বিপুল সামরিক সহায়তায়। শেষ পর্যন্ত রোনাল্ড রিগ্যান প্রশাসন থেকে ৩.২ বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ পান তিনি।
একইসঙ্গে জিয়া ঘনিষ্ঠ হন চীনের সঙ্গে। ইরাক ইরান যুদ্ধে প্রকাশ্যে নিরপেক্ষ থাকলেও গোপনে সমর্থন দেন ইরানকে। বলা হয়, সেসময় মার্কিন ও চীনা অস্ত্র গোপনে ইরানের হাতে পৌঁছে দিতে পাকিস্তানই মধ্যস্থতা করেছিল।
সেই মরণযাত্রা
১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট জিয়া ছিলেন বাহাওয়ালপুরে। মার্কিন ট্যাঙ্ক এম১ আব্রামস এর মহড়া দেখে ফিরে আসছিলেন ইসলামাবাদে। পাকিস্তান সময় বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে বিশেষভাবে সাজানো সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানটি আকাশে ওঠে। বিমানে ছিলেন ৩০ জন যাত্রী ও ক্রু।
দুই মিনিট উড়ে যাওয়ার পরেই কন্ট্রোল রুমের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী বিমানটি নিচ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন অস্বাভাবিক দুলতে শুরু করে। হঠাৎ প্রায় খাড়াভাবে নিচে নেমে ভয়াবহ বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হয়। এতো ভয়াবহ বিস্ফোরণ যে সাথে সাথেই বিমানের সবাই মারা যায়।
দুর্ঘটনা না হত্যাকাণ্ড?
পাকিস্তানের সরকারি তদন্তে ধারণা করা হয় এটি পরিকল্পিত নাশকতা। সেই তদন্ত মতে বিমানে গোপনে বিষাক্ত গ্যাস ছাড়া হয়েছিল, যা ক্রু ও যাত্রীদের অচেতন করে দেয়। আশ্চর্যের বিষয়, দুর্ঘটনার পর ওই বিমানের কোনো ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। যা এই দুর্ঘটনাকে আরও সুপরিকল্পিত নাশকতা বলেই প্রমাণ করে।
আরও অদ্ভুত ছিল মার্কিন প্রতিক্রিয়া। যদিও একজন মার্কিন দূত ও জেনারেল নিহত হয়েছিলেন, তবুও এফবিআইকে তদন্তের সুযোগ দেওয়া হয়নি। এফবিআই তদন্ত করতে চাইলে মার্কিন সেন্টকম অনুমতি দেয় নি। পরিবর্তে পেন্টাগন ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের মধ্যে একটা আন্ত-ডিপার্টমেন্টীয় তদন্তের সুযোগ দেয়া হয়। দুই মাস পর মার্কিন প্রশাসন চাউর করে যে এই বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়েছে এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ির কিছু নেই।
ইসরাইলি যোগসূত্রের অভিযোগ
সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগটি তুলেছিলেন সে সময় ভারতের মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন গুন্থার ডিন। ৪০ বছর বিভিন্ন দেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই অভিজ্ঞ কূটনৈতিকের মতে, জিয়াকে সরাতে চাইছিল ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ২০০৫ সালে “জিয়াকে কে হত্যা করেছে” শিরনামের ৫০০০ শব্দের একটা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট ছাপানো হয় নিউ ইয়র্কের দা নিউ স্কুল এর ওয়ার্ল্ড পলিসি জার্নালে। সেখানে বহু ব্যক্তির সাক্ষাতকারও নেয়া হয়। ডিনের সাক্ষাতকারে তিনি স্পষ্টই উল্লেখ করেন যে জিয়াউল হককে মৃত্যুর পিছনে মোসাদের সরাসরি হাত আছে।
কারণ জিয়া শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, বরং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গেও পরমাণু প্রযুক্তি ভাগাভাগি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে মধ্য প্রাচ্যের কিছু মুসলিম দেশও ছিল। এ সম্ভাবনা ইসরাইলের নিরাপত্তা মহলে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। সাংবাদিক এরিক মার্গোলিসের মতে, পাকিস্তানের পরমাণু স্থাপনায় যৌথ হামলা চালানোর জন্য ভারতকে বহুবার প্রস্তাব দিয়েছিল ইসরাইল। কিন্তু ভারত নিজের অবস্থান এবং নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। পরবর্তীতে ইসরাইল জিয়াউল হককে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে দুজন মার্কিন নাগরিককে বলি দেয় তারা।
ডিন যখন এ সন্দেহের কথা ওয়াশিংটনে জানান, তখনই তাকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার কাছে থাকা তথ্য তদন্তের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে তাকে ভারত থেকে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠায়। তাকে জানানো হয় তদন্তের স্বার্থে তার এই তথ্য সরাসরি মন্ত্রণালয়ে জানানো দরকার। কিন্তু তিনি ওয়াশিংটনে অবতরণের পরপরই তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ ঘোষণা করা হয়। আর তাকে ভারতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফিরতে দেয়া হয় না এবং কূটনৈতিক ক্যারিয়ার সেখানেই শেষ হয়। এমনকি সেই ৫০০০ শব্দের রিপোর্ট যিনি লিখেছেন তাকে চাকরীচ্যুত করা হয়। এমনকি তাকে আমেরিকার সব প্রকাশনী, ম্যাগাজিন, পত্রিকা থেকে বয়কট করা হয়। দা নিউ স্কুলের ওয়ার্ল্ড পলিসি জার্নালের প্রধানকেও বরখাস্ত করা হয়। ওই রিপোর্টটি জার্নালের ওয়েবসাইট থেকে তুলে দেয়া হয়। রিপোর্টের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এবং এই বিষয়ে আমেরিকার কোন গণমাধ্যমকে আর কোনও খবর করতে দেয়া হয়নি।
জিয়ার ছায়া আজও পাকিস্তানে
আজও পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে চীন ও ইরানের সঙ্গে জোট, জিয়ার কূটনীতির ধারা বহন করে চলেছে। তবে এই সম্পর্কের কারণে পাকিস্তান বারবার পশ্চিমা চাপের মুখে পড়ছে—যেমনটা জিয়ার আমলেও হয়েছিল।
ইমরান খানের পতন নিয়েও বিশ্লেষকরা একই সাদৃশ্য খুঁজে পান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রশ্নে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করায় ইসরাইল ক্ষুব্ধ হয়েছিল —যেমনটি জিয়ার সময় ইরান নীতি নিয়ে হয়েছিল। জিয়াকে শেষ করে দিয়েছিল। ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবনকে শেষ করার চক্রান্ত চলছে। তাকে জেলে পুরে রাখা হয়েছে। ঘটনাটি অভ্যন্তরীণ রাজনীতি হিসেবে দেখা হলেও এর পিছনে আছে বিশাল আন্তর্জাতিক হিসাব নিকাশ। ইমরান-মাহাথির-এরদোয়ান মিলে যে জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তার পরপরই ইমরান এবং মাহাথির ছিটকে পরেন।
ইরানের প্রেসিডেন্টেকে বহনকারী হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়া, লেবাননের বৈরুত বন্দরের সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ, হামাস ও হিযবুল্লাহ নেতাদের হত্যা, ইরানের সামরিক নেতাদের এক বোমায় হত্যা সবগুলোই যেন একই জায়গা থেকে পরিচালিত ঘটনা এবং কাকতালীয় হলেও সত্য যে কোনটারই সঠিক এবং বিস্তর তদন্ত সামনে আসছে না।
অমীমাংসিত রহস্য
জেনারেল জিয়াউল হকের মৃত্যু পাকিস্তানের ইতিহাসে এক অমীমাংসিত অধ্যায়। দুর্ঘটনা না ষড়যন্ত্র—এ প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা। তবে একথা স্পষ্ট, তার মৃত্যু শুধু একজন শাসকের অবসান ঘটায়নি; এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিকে নতুন পথেও ঠেলে দিয়েছিল।
নিউজ টুডে বিডি/নিউজ ডেস্ক