
রাশেদুল হকঃ গণমাধ্যমকর্মীরা কিভাবে অন্যায়কে মাথা পেতে নিয়ে, অন্যায়ের সাথে আপোষ করে চলছে তা ভাবতে অবাক লাগে! রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ আজ ভীষণ নড়বড়ে! জাতির বিবেক নিজেই আজ নিজেকে করছে কলুষিত! কলম সৈনিক ভীরু কাপুরুষের ন্যায় অন্যায়কারীর পক্ষ নিয়ে স্তুতি গাইছে, যা মূলত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করার শামিল! মাঠ পর্যায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহকারী সত্যপূজারী সাহসী ব্যক্তিটিও, তার সংগৃহিত সংবাদটি হালের অনলাইন কিংবা হার্ডকপিতে ছাপা না হওয়ার হতাশা, ক্ষোভে পরিবার-পরিজন, বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নিজের নীতিকে বুড়িগঙ্গার কটূজলে বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছেন প্রতিনিয়ত! দেশ ও জাতি বঞ্চিত হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রাপ্তি থেকে। বিশ্বাস আর অনাস্থা বাড়তে বাড়তে এমন এক অবস্থায় পৌঁছুচ্ছে, যেখান থেকে সহসাই গণমাধ্যমের কিংবা গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি আপামর জনসাধারণের ভরসা তলানি থেকে চূড়ায় উঠতে পারছে না।
এমন চরম অধঃপতিত অবস্থার জন্য দায়ী কে?
কেনো একজন সম্পাদক কিংবা প্রকাশক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, অপরাধ বিষয়ক সংবাদ প্রকাশের চেয়ে অন্যান্য বিষয়ের প্রতি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন? এর পেছনে কলকাঠি কে নাড়ে? কিসের ভয় কিংবা আতঙ্কে তাঁকে প্রতিনিয়ত তটস্থ থাকতে হচ্ছে? মানসম্পন্ন একটি অপরাধ বিষয়ক সংবাদ ছাপাতে কেনো তাঁকে বারংবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হচ্ছে? অবাধ-মুক্ত গণমাধ্যম ব্যবস্থায় একজন সম্পাদক কিংবা প্রকাশককে কি কখনো কপালে এতো বেশি ভাঁজ ফেলে তাঁর কর্মীদেরকে দিক নির্দেশনা দিতে হয়!
সরকারী বিজ্ঞাপনসহ বেসরকারী, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত হবার ঘটনা অহরহ ঘটার কারণে ব্যবসায় মারাত্মক ক্ষতি হবার আশংকায়, মিথ্যা মামলায় জেল-জুলুমের ভয়, দাপুটে ক্ষমতাধর কারো বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হবার, কিংবা খুনের শিকার হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকায় অনেক প্রথিতযশা সম্পাদক-প্রকাশকও নিজেকে গুটিয়ে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন, যা মোটেও একটি জাতির জন্য শুভ লক্ষণ নয়!
নিজ হাউসের এমন ভীরুতা, পশ্চাদপদতা, তোষামোদে পারিপার্শ্ব চাক্ষুস হয়ে সে হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের একজন প্রতিনিধিও তখন গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে, ঋণাত্মক সংবাদ সংগ্রহে বিমুখ হয়ে চাটুকারীতা, তেলবাজীতে লিপ্ত হয়ে নিজের অবস্থান, মেধা-মনন, সৃজনশীলতার জলাঞ্জলি দিয়ে টু-পাইস কামিয়ে নেবার ধান্ধায় লিপ্ত হতে মোটেও কুন্ঠিত না হয়ে, তা করতে পারাকেই নিজের সফলতা ভাবতে শুরু করে এ পেশাকে সাধারণ মানুষের নিকট করে তুলছে ঘৃণার, উপহাসের!
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবে, অনিচ্ছা স্বত্তেও অনেক সাংবাদিককে এ পেশায় সততার সাথে কাজ করে হামলা-মামলার মুখোমুখি হয়ে, জীবন দেবার মতো ঘটনা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠলেও, তার সুষ্ঠু তদন্ত, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হবার কারণে এক ভয়ের সংস্কৃতি কিংবা আবহ তৈরী হয়েছে সর্বত্র! সব দেখেও না দেখা, সব শুনেও না শোনার মত করে নামকাওয়াস্তে সংবাদ পরিবেশন, পাঠকের ঈপ্সিত চাহিদা মেটাতে পারছে না। গণমাধ্যমের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতি অধিকতর আস্থাশীল হয়ে পড়ার দরুণ সংবাদপত্র-সাংবাদিক তাদের কাছে হয়ে উঠেছে নস্যির মতো! ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা তালিকাভুক্ত, তালিকাবিহীন পত্রিকা, অসংখ্য টিভি চ্যানেল দেশে বিদ্যমান থাকলেও খবরের অন্তরালের খবর প্রকাশ না পাওয়ায়, সংশয় প্রকাশ করে ভুক্তভোগীরা মুখবন্ধ করে রাখতেই স্বস্তি প্রকাশ করে থাকেন কোন কারণে তা সকলেরই জানা!
অবাধ তথ্যপ্রবাহের কথা বলা হলেও তথ্যপ্রাপ্তিতে প্রতিনিয়ত ন্যাক্কারজনকভাবে ভোগান্তির শিকার হলেও সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। ক্ষেত্রবিশেষে চাঁদাবাজি, মানহানী মামলার শিকার হবার নজির রয়েছে ভূরি ভূরি! সাংবাদিকবান্ধব কোনও আইন না থাকায় চরম এক অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে এ পেশায় টিকে থাকতে হচ্ছে সত্য সংগ্রামী প্রকৃত যোদ্ধাদের! তাদের শুচিশুভ্র পেশায় কালিমালিপ্ত করছে সাংবাদিক নামধারী তথাকথিত আরেক শ্রেণীর পরাশ্রয়ী, সুযোগসন্ধানী সাংবাদিক তকমাধারীরা! এদের কারণেই সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ মহান পেশাটি! প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনও বালাই না থাকলেও যত্রতত্র নিজেদেরকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে তারা প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকদের জাত মেরে মুখে চুনকালি দিচ্ছে। ঢালাওভাবে সব সাংবাদিককে এক পাল্লায় মেপে তাদেরকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছে এসব অপদার্থরাই!
সব মিলিয়ে চরম এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে এ পেশায়! শ্যাম রাখি না কূল রাখির মতো দোদুল্যমান থেকে মূল ঘটনা থেকে বহুদূর সরে গিয়ে, কোনও এক শুষ্ক বালুর চরে গিয়ে মুখ লুকোনোর নীতিতে, আর যাই হোক সাংবাদিকতা তার পরিপূর্ণতা পায়না!
বাকপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে যতো উদ্যোগই নেয়া হোক না কেনো, তা মুখ থুবড়ে পড়বেই! বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে বাঁচাতে হলে “লাইফ সেভিং” ড্রাগসের মতো কোন যাঁদুর কাঠি আমাদের করায়ত্ত্ব হবে তা সময়ই বলে দেবে!