
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ইমাম নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত চলবে মর্মে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিষয়টি তদন্তের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা অসংখ্য আবেদন করলেও ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন তা আমলে নেননি। অত্যন্ত মর্যাদাশীল এ পদটিতে মাওলানা এহসানুল হককে নিয়োগের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। শুনানী শেষে রিট দায়েরকারীকে উক্ত পদে নিয়োগের আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। সে সাথে মাওলানা এহসানুল হকের নিয়োগের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। মাওলানা এহসানুল হক ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক মরহুম সামীম মো. আফজালের ভাগিনা এবং তার কর্মকালে নিয়োগ দেয়া হয়। মাওলানা এহসানুল হকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা ছাড়াই চাকরী নেয়ার অভিযোগ উঠে। মাওলানা মোখলেছুর রহমান নামক একজন প্রার্থীর রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি নাঈমা হায়দার এবং বিচারপতি মো. খায়রুল আলম সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ সম্প্রতি এ রায় প্রদান করেন।
আদালতের রায়ে ইমাম পদে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ বিষয়ে এ মূহুর্তে আদালতের হস্তক্ষেপ না করে বিষয়টি কর্তৃপক্ষের উপর ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়। এতে বলা হয় বায়তুল মোকাররমে ইমাম পদে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত কাজ কর্তৃপক্ষ এখনো শেষ করেননি। তাই নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব পন্থায় তদন্ত কাজ চালিয়ে যাবেন। রিট দায়েরকারীর উক্ত পদে নিয়োগের আবেদনও এ মর্মে খারিজ করে দেয়া হয় যে আবেদনকারীর নিজেরই প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক সামীম মো. আফজালের কর্মকালে তার আপন ভাগিনা মাওলানা এহসানুল হককে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই বায়তুল মোকররম মসজিদে ইমাম পদে নিয়োগের অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ঐ সময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এ সম্পর্কিত অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হয়। অভিযোগে বলা হয় মাওলানা এহছানুল হকের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। তার পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ ভূয়া। তার মামা নিজে নিয়োগ কমিটির সভাপতি থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে তাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এ নিয়োগে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগে উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ২০১২ সালে ইমাম পদে নিয়োগের পর পরই এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ইমাম পদের প্রার্থী মাওলানা মোখলেছুর রহমান হাইকোর্টে রিট পিটিশন নং ১৪৮৭৬/১২ দায়ের করেন। কিছুদিন পূর্বে এ রিটের শুনানী সম্পন্ন হয় এবং গত মঙ্গলবার এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। আদালতে বলা হয়, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ দেশের মানুষের ধর্মীয় আবেগের কেন্দ্রবিন্দু । তা সত্বেও এখানে ইমাম নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ কর্তৃপক্ষ তা আমলে নিচ্ছেন না। ইতিপূর্বে আদালতের নির্দেশে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন হলেও ৩ জন সদস্য প্রভাবিত হয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেননি। এটি চাকরী বিধিমালায় অসদাচরণের শামীল। মাত্র ২জন সদস্য তদন্ত প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করেন। আদালত তাদের রায়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির ২ জন সদস্যের প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরেন। উক্ত অংশে বলা হয় ‘‘সরকারের রাজস্ব খাতভুক্ত ইমাম পদে নিয়োগের জন্য মাওলানা এহছানুল হকের প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছিলনা। বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী তার ‘কামিল’ সমমান কোন সনদ এমনকি সরকার স্বীকৃত কোন সনদও তার ছিল না। তার নিয়োগের সময় পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে সহকারী অধ্যাপক সমমান মুফাসসির হিসেবে ৫ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। সে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাও তার ছিল না। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রথম শ্রেণীর পদে বাধ্যতামূলকভাবে ৮ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। তার এ ধরনের কাজের কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কারণ তিনি দাওরা পাস করার ৫ বছর পরই চাকরীর জন্য আবেদন করেন। প্রাথমিক বাছাইয়ে তার আবেদন বাদ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি এবং চূড়ান্ত ভাবে তিনিই নিয়োগ লাভ করেন। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ইমাম পদটিকে ২য় শ্রেণীর পদ উল্লেখ করে প্রথম শ্রেণীর পদে ৮ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।
স্বজনপ্রীতির উদ্দ্যেশ্যে কম আবেদন জমা হওয়ার জন্য এটি চাতুর্যপূর্ণ কৌশল ছিল। বাংলাদেশে কোন সরকারী সংস্থায় রাজস্বপদে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রবেশকালীন বেতন ৯ম গ্রেডের উপরে দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু মাওলানা এহছানুল হককে পূর্বে সরকারী পদে চাকরীর কোন অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগপত্রে সরাসরি সিনিয়র সহকারী সচিবের স্কেলে (৬ষ্ঠ গ্রেড) বেতন দেয়া হয়। সিলেকশান কমিটির সুপারিশে পেশ ইমাম পদটিকে টেকনিকেল পদ দেখানো হয়েছে। এটি আদৌ কোন টেকনিকেল পদ ছিল না। কারণ এখানে টেকনিকেল কলেজ থেকে কোন ডিগ্রির বিষয় ছিল না। মাদরাসা শিক্ষা কোন টেকনিকেল শিক্ষা নয়। এ নিয়োগের সময় বায়তুল মোকাররমের খতীবসহ সিলেকশান কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যেমন সিলেকশান কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে কর্মরত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সচিব, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির স্বাক্ষর ছাড়াই এবং বোর্ডের অনুমোদনের আগেই মাওলানা এহছানুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিলেকশান কমিটির সভাপতি এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল তার নিকটাত্মীয় (ভাগিনা) ইমাম পদে প্রার্থী থাকার বিষয়ে কোন প্রকার ঘোষণা (উবপষধৎধঃরড়হ) দেননি। কমিটি আরো বলেন, মাওলানা এহসানুল হকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ; স্বীকৃতি বিহীন সনদ এবং মিথ্যা অভিজ্ঞতার সনদ দিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পেশ ইমাম পদে নিয়োগ লাভের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত”।
সার্বিক দিক বিবেচনা করে আদালত রিট দায়েরকারী মাওলানা মোখলেছুর রহমানের ইমাম পদে নিয়োগের আবেদন বাতিল করে দেন এবং মাওলানা এহসানুল হকের নিয়োগের অনিয়মের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে তদন্ত কাজ চালিয়ে যেতে নির্দেশ প্রদান করেন। রিট আবেদকারী মাওলানা মোখলেছুর রহমানের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ব্যারিষ্টার বেলায়েত হোসেন এবং মাওলানা এহসানুল হকের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট ইয়াছিন শিকদার।