
‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’ এই কথা রবীন্দ্রনাথ রূপকার্থে লিখেছিলেন, বায়ু দূষণের কথা ভেবে লেখেননি। কারন, বায়ু দূষণ কিংবা শব্দদূষণ বলতে এখন যা বোঝায়, রবীন্দ্রনাথের কালে অন্তত এই অঞ্চলে তা ছিল না। এখন ভারী কলকারখানা, ইটের ভাটা, রাসায়নিক প্লান্ট, হাইড্রোলিক হর্ন, মাইকের উচ্চ শব্দ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, অপরিকল্পিত শহরসহ ইত্যাদির উৎপাতে কুবাতাস এতটাই বেড়েছে যে বিশেষত ঢাকাবাসী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে আছে।
বায়ু দূষণ পরিবেশের জন্য একটি মারাত্মক ক্ষতিকর দিক, যা বাংলাদেশে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বৈশ্বিকভাবে পরিসংখ্যানে লজ্জাজনক অবস্থানে। দেশের জনসাধারণের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। কেননা যেখানে শত ভাগ লোকের জন্য মানসম্মত ন্যূনতম চিকিৎসা নিশ্চিত করার দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে নিত্য-নতুন রোগজীবাণু বৃদ্ধি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ। কিন্তু এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে পুরো দেশে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে। কেননা প্রতিবছর দূষণের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন রোগের কারণে মৃত্যুর মধ্য পরিবেশ দূষণে প্রায় ২৮ শতাংশ লোক মারা যায়। এছাড়াও বায়ু দূষণের সঙ্গে অন্যান্য দূষণও বেড়ে যাওয়ায় আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। যার প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে এসব সমস্যার সমাধান না হলে অধিক ক্ষতির মুখোমুখি আমাদের হতে হবে।
পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্রিন পিস’, তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন যে তথ্য দিয়েছে, তা ভয়াবহ। তারা বলছে, ‘বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বায়ু দূষণজনিত রোগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার শিশুর অকাল মৃত্যু হয়েছে। বছরে ৪০ লাখ মানুষ এ্যাজমা শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোতে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঢাকার বাতাস অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল, দূষণের দিক থেকে বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ। এর পাশাপাশি আছে শব্দদূষণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, শব্দের সহনীয় মাত্রা হলেও ঢাকার বেশিরভাগ এলাকায় ৯০ ডেসিবেল এর বেশি মাত্রায় শব্দ হয়। কোথাও কোথাও আবার ১০০ ছাড়িয়ে যায়। রাজধানীর একটি অংশ মানুষ এখন শব্দ দূষণে আক্রান্ত। এভাবে শব্দ থাকলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার তিনভাগের একভাগ কানে কম শুনবে। এদের একটি অংশ পুরোপুরি বধির হয়ে যাবে। বিশ্বের সবচাইতে দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে যেসকল নগরের নাম ২০১৯ সালে বারবার উচ্চারিত হয়েছে ঢাকা তার মধ্যে একটি। মাত্রাতিরিক্ত ধূলি রাজধানী ঢাকার দূষণের মাত্রা আরো বাড়িয়েছে। ইটভাটা, যানবাহন নির্মাণ্ কলকারখানার দূষিত ধোঁয়ার কারণে বাড়ছে দূষণ। উল্লেখ্য স্বাস্থ্য সংস্থার বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি ২০১৭ এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল ‘১৯৯০ হতে ২০১৫ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণ বেড়েছে ভারত আর বাংলাদেশে।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুতে যে পরিমান যে সকল ক্ষতিকারক উপাদান থাকে, তাহার মধ্যে সবচাইতে মারাত্মক পি.এম ২.৫। এই উপাদান নির্গমনকারী দেশ সমূহের মধ্যে চীন ও ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। অবাক হবার বিষয় হল যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বৈশ্বিক বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষনকারী সংস্থা ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর দেয়া তথ্য মতে বায়ুদূষণে ১৭১ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল ১ নম্বরে। দ্বিতীয় অবস্থানে ভারতের মুম্বাই। একই দিনে প্রকাশিত ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এ্যন্ড ক্লিন এয়ার’ এবং ‘গ্রিন পিস’ এর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া শাখার এক গবেষনায় বলা হয়েছে, ‘বাতাসে ২.৫ পি.এম (পার্টিকুলার মিটার) আকারের ভারী কনার দূষণে ২০১৮ সালে বিশ্বে ৪৫ লক্ষ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশে মারা গিয়েছে ৯৬ হাজার মানুষ। ’
সর্বোপরি দেখা যাচ্ছে, বায়ু দূষণের পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের এক সংস্থার সাথে আরেক সংস্থার সমন্বয় না থাকায় যে যার মত রাস্তা খুড়িয়েছে। কোথাও ওয়াসা, কোথাও মেট্রোরেল, কোথাও বিআরটিএ, কোথাও ডেসকো খোড়াখুড়ি করে উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রেখেছে। ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন পরিবেশ থাকার ফলে বায়ুদূষণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর হতেও দূষণরোধে নেই কোনো জোরালো পদক্ষেপ। যার কারণে ঢাকার বায়ুদূষণ কোনরকম কমছে না। ঢাকার বায়ুদূষণের প্রভাবে মানুষের উপর এমনভাবে পড়ছে যে, সুস্থভাবে বের হয়ে দিনশেষে তারা ঘরে ফিরছে অসুস্থ হয়ে। জনে জনে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানী, ব্রংকাইটিস, যক্ষা, যকৃতের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগ ও নিউমোনিয়ার মতো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে অহরহ। এর পাশাপাশি হার্টের বিভিন্ন সমস্যা ও ডায়াবেটিকসের সমস্যা তো আছেই! অসহায় বোধ করছে জনস্বাস্থ্যবিদেরা। রাজধানী ঢাকার ভয়াবহ বায়ুদূষণের সবচাইতে বড় শিকার হচ্ছে শিশুরা, বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের বুদ্ধির বিকাশ।
বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৯ সালেও বায়ুদূষণ জনিত রোগে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জনের মৃত্যু হয়। দেশে ২০১২ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অব কলাম্বিয়া’ ও ১হেলথ ইফেক্ট ইন্সটিটিউটে’র বিশ্ব বায়ু পরিস্থিতি ২০২০ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এতে বায়ুদূষণে শিশু মৃত্যুর বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উঠে আসে। বলা হয়, বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর শিশু মৃত্যুর (নবজাতক) ২০ শতাংশ হয় বায়ুদূষণজনিত নানা রোগে ভুগে। প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচাইতে দূষিত বায়ুর অঞ্চল হিসেবে দক্ষিন এশিয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও পাকিস্তানে বায়ুদুষণ দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশে। দেশে গত বছর উচ্চ আদালত বায়ু দূষণরোধে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারী সংস্থা গুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, তারা এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেছে। বাস্তবায়ন শেষ হলে আগামি ২/৩ বছরের মধ্যে ঢাকাসহ আশপাশের বায়ু মানে উন্নত হবে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুর মান বিভাগের পরিচালক বলেন, ‘আমরা গত বছরের বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ৭০০ ইটভাটা বন্ধ করেছি।’
বিশ্ব বায়ুদূষণ পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বায়ু দূষণ রোধে নির্মল বায়ু আইন প্রনয়নের প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এই আইন প্রণয়ন রোধে তারা সব সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বায়ুর মান পরিস্থিতির উন্নত হতে পারে’। এরপর বায়ু পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর কারন গুলোর মধ্যে চতুর্থ শীর্ষ বায়ুদূষণ। ২০১৯ সালে বায়ু দূষণের কারনে বিশ্বে সাড়ে ৬৭ লাখ মানুষ অকালে মারা গেছে। বায়ু দূষণজনিত রোগে ভারতে ১৬ লাখ ৭০ হাজার, পাকিস্তানে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭০০ ও নেপালে ৪২ হাজার মানুষ মারা যায়। বাতাসে অতি সুক্ষ কণাজনিত বায়ুদূষণের দিক দিয়ে শীর্ষ ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। এ তালিকায় ভারত, নেপাল, নাইজার, কাতার, নাইজেরিয়াম মিশর, মৌরিতানিয়া, ক্যামেরুল, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান রয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্ব বায়ু পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘যে সব দেশের বায়ুর মান খারাপ, সেসব দেশে করোনা সংক্রমন দ্রুত হচ্ছে। ফলে করোনা বায়ুদূষণ রোধে এ ব্যবস্থাকে সামগ্রিক ভাবে দেখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ এখন নাজেহাল। পারিপার্শ্বিক কারনে সে তুলনায় চিকিৎসা ও সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ! দেখা যাক মৌলিক কতিপয় কারনে বায়ুদূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে।
১. রাস্তাঘাট খনন করে মাটি উন্মুক্ত রাখা।
২. বেহাল ভাঙ্গাচোরা রাস্তাঘাট।
৩. অপরিকল্পিত কনস্ট্রাকশন।
৪. উন্মুক্তভাবে মাটি-বালি পরিবহন।
৫. অপরিকল্পিত ও অ-অনুমোদিত ইটভাটা।
৬. যত্রতত্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
৭. বৃক্ষ নিধন ও সবুজায়নের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।
৮. ট্যানারি বর্জ্য খোলাভাবে রাখা ও যথাস্থানে না ফেলা।
৯. প্লাস্টিক বর্জ্য ক্রমেই বৃদ্ধি।
১০. উন্মুক্ত ড্রেন ও নর্দমার হাজামজা।
১১. হাস্পাতাল বর্জ্য যথাযথভাবে সংরক্ষন না করা।
১২. ফিটনেসবিহীন গাড়ীর বিষাক্ত ধোয়া।
১৩. খোলা জায়গায় ময়লা ফেলে রাখা।
১৪. অবহেলিত খাল নর্দমায় পরিনত ও ময়লার ভাগাড়।
১৫. সর্বোপরি, মানুষের অসচেতনতা।
সামগ্রিক দিক থেকে দেখলে এই বায়ু দূষণের ফলাফল অতি ভয়াবহ। বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছরে ৭০ লাখ মানুষ অপরিণত বয়সে মারা যায়। ভাবতে অবাক লাগার মতো যে এই বায়ু দূষণে ঢাকা শহর মৃত্যুপুরীর শিরোপা জিতে বসে আছে! যার কারণে মানুষের মধ্যে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং আরো অনেক ধরনের ক্রনিক ফুসফুসের রোগ বেশিহারে হচ্ছে। নাটকীয় মনে হলেও এটাই সত্য যে তীব্র বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের বুদ্ধি কমে যাবার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে এক নতুন গবেষনায় উঠে এসেছে। নতুন গবেষনাটি পরিচালিত হয়েছে চীনে।
ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস বাংলাদেশে এখন প্রধান রোগ। এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে ২/১ জন ডায়াবেটিসের আক্রান্ত নেই। আগে শোনা যেত বয়সের একটা পর্যায়ে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। বর্তমান সেটা অন্য এক সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে রূপ লাভ করেছে। আর ডায়াবেটিস এমন এক রোগের নাম, যা শরীরের সকল গতি প্রকৃতিকে নষ্ট করে দেয়। শরীরের অন্যান্য বড় বড় কঠিন রোগ এই ডায়াবেটিস হতে সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের এক নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে যে বায়ুদূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের ঝুকি বাড়ার বেশ গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন, ২০১৬ সালে বিশ্বে প্রতি সাতটি নতুন ডায়াবেটিস কেসের একটির পেছনে আছে ঘরে বাইরে বায়ুদূষণ। সে বছর বিশ্বে শুধু বায়ু দূষণের কারন ও প্রতিকার সম্পর্কিত আলোচসায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী বলেন, ‘নগরীর বিভিন্ন স্থানে ভবন নির্মাণের সময় পানি ছিটানো, নির্মাণ সামগ্রী যত্রতত্র ফেলে না রাখা ও নির্মাণের ক্ষেত্রে নির্মাণ সামগ্রী নির্ধারিত বেষ্টনির মধ্যে আছে কিনা সেটি দেখতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে বায়ু দূষণের প্রধান ৩টি উৎস নিয়ে চলতি বছরের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত গবেষনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে ইটভাটা, যানবাহনের কালো ধোয়া ও নির্মান কাজ। আট বছর ধরে এই তিনটি উৎস ক্রমেই বাড়ছে।
অন্যদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে দেশে ইট ভাটার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৯১৫। পরে ২০১৮ সালের পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে দেখা যায়, দেশের ইটভাটার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৯০২ টি। এর মধ্যে ২২ হাজার ৪৮৭ টি ইটভাটা ঢাকা বিভাগের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এ গবেষনার তথ্যানুযায়ী ২০১০ সালে দেশে মোট যানবাহনের পরিমান ছিল ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৭৭। যা ২০১৮ সালে বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৫৪। সার্বিক বিবেচনায় সরকারের উচিত আশু সমাধানে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেয়া।
হৃদরোগ: হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমন দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেমিক্যাল মেশানো ভেজাল খাদ্যাভ্যাস ও মানুষের জীবনযাপনের ধারা পবির্তনের কারণে হৃদরোগ আমাদের সমাজে মারাত্মকভাবে বাসা বাধছে। সেক্ষেত্রে দেশে বেশি মৃত্যু হচ্ছে হৃদরোগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় জরিপ বলছে, ২০২০ সালে ২ লাখ ২৪ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে হৃদরোগে (হার্ট এটাক ও হার্ট ডিজিজ)।
এই জরিপে বলা হয়েছে, হৃদরোগসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ৭৫ ধরনের রোগ ও দুর্ঘটনায় গত বছর ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২৫৩ জনের মৃত্যু হয়। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ২ হাজার ৩৪০ জনের মৃত্যু হচ্ছে। আগের বছরের চেয়ে ২০২০ সালে মৃত্যু বেড়েছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অসংক্রমন রোগে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে হৃদরোগ, ক্যানসার, কিডনীরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহসহ আরো কিছু বিশেষ রোগ। এই জরিপ অনুযায়ী ২০২০ সালে শুধু হার্ট এটাকে ১ লক্ষ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। যা আগের বছরের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি।একই ভাবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরনে মারা যান ৮৫ হাজারেরও বেশি। যা বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। আট ধরনের ক্যানসারে মৃত্যু হয় ৮৩ হাজার বেশি মানুষের। বাড়ার হার ৩২ শতাংশ। এছাড়া শ্বাসতন্ত্রের রোগে মারা যান প্রায় ৭৪ হাজার, এক্ষেত্রে মৃত্যু বাড়ার হার ৩৬ শতাংশ। কিডনী রোগে মারা যান ২৮ হাজারের বেশি মানুষ, এক্ষেত্রে মৃত্যু ১৬৪ শতাংশ বেড়েছে।
মা ও শিশু: দেশে বন্ধাত্বের সমস্যা বাড়ছেই। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ৪৫ শতাংশ দম্পত্তি বন্ধাত্ব সমস্যায় ভুগছে বলে জানান ‘অবসটেকনিক্যাল এন্ড গাইনোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ (ওজিএসবি) নেতৃবৃন্দ। বিশেষজ্ঞদের হিসেব ও পর্যালোচনা এর কারণ হল বায়ু দূষণ, ভেজাল খাবার, দেরিতে বিয়ে, মানসিক চাপ, হাটুর উপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করা, স্মার্ট ফোনের মাত্রাতিরোক্ত ব্যবহারে রেডিয়েশনকেই দায়ী করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যার ৮ থেকে ১০ ভাগ দম্পত্তি কোনো না কোনো ধরনের বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভূগছেন। তবে বাংলাদেশে এর সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা যায় এই সংখ্যা বাড়ছেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস এন্ড গাইনি বিভাগ ‘বন্ধ্যাত্ব জটিলতা’ শীর্ষক একটি গবেষণা করেছে। তাতে দেখা গেছে শতকারা ৪৫ শতাংশ দম্পত্তি বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছেন। তার পেছনে কারণ ও বাস্তবতা উঠে এসেছে এদেশের পরিবেশ ও বায়ু দূষণ ই প্রধান কারন।
সম্প্রতি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের এক পর্যালোচনায় আরো বলা হয়েছে যে, ‘ডিজিটাল যুগে ল্যাপটপ ও মোবাইল ছাড়া আমাদের এক মুহুর্তও চলে না। ছেলেদের অনেক সময় দেখা যায় দীর্ঘক্ষন হাটুর উপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করতে। ফলে ল্যাপটপের রেডিয়েশন ছেলেদের স্পার্ম নষ্ট করে দেয়। যার ফলে ছেলেরাও বন্ধ্যা হয়। একই ভাবে স্মার্ট ফোনে কাজ করায় সেখান থেকে নির্গত রেডিয়েশন বন্ধ্যাত্বের অন্যতম একটি কারণ।’ এছাড়া দেশের পরিবেশ ও বায়ু দূষণ বিশেষভাবে আমাদের দাম্পত্য জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
উচ্চমাত্রায় বায়ু দূষণের কারণে শারীরিক ও মানসিক বিকলাঙ্গ অর্থাৎ নির্বোধ শিশুর সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষনা সংস্থা হেলথ ইফেক্ট ইন্সটিটিউট এর ভাষ্যানুসারে বায়ু দূষণের কারণে প্রায় প্রত্যেকেই নানা রকম শারীরিক ও মানসিক ব্যাধিত আক্রান্ত হচ্ছে এবং এ কারণে নির্বোধ ও বিকলাঙ্গ জাতিতে পরিণত হওয়ার আশংকায় রয়েছে।
বায়ু দূষণের ফলে শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অবস্থান দ্বিতীয়। ইটের ভাটা, অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ কাজ করা, রাস্তা খোড়াখুড়ি ও আবর্জনা পোড়ানোসহ নানা কারণে এ অবস্থার তৈরী হয়েছে বলে মনে করছেন বায়ুমান গবেষকরা। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে এ আই এল ইউ বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথ একটি গবেষণা পরিচালনা করে। তাতে রাজধানী ঢাকা সহ আশপাশের বায়ু দূষণের ইটভাটা, সড়কের বিষাক্ত ধুলা, যানবাহন, বায়োগ্যাস পোড়ানো সহ অন্যান্য অবস্থাকে দায়ী করা হয়। সেখানে শিশুদের জন্য অসহনীয় ও মারাত্মক বলে এ পরিবেশকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, ঢাকার দূষণের জন্য ইটভাটা ৫৮ শতাংশ, সড়কের ধুলা ১৮ শতাংশ, বায়োগ্যাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারন ৬ শতাংশে দায়ী করা হয় বলে জানানো হয়।
ইউনিসেফের এক গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বের ৩০ কোটি শিশু দূষিত বায়ুবেষ্টিত এলাকায় বাস করে। যার মধ্যে ২২ কোটি দক্ষিণ এশিয়ায়। বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর পাঁচ বছর বয়সী ৬ লাখ শিশু মারা যায়। শিশু ও বৃদ্ধ বয়সীরা বায়ুদূষণের ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ জীবনদশার এ সময়ে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। অপরদিকে ছোট বাচ্চাদের ফুসফুস বড়দের মতো পরিণত না হওয়ার ফলে বায়ু দূষণের প্রভাব তাদের ওপর বেশি পড়ে।
বিষন্নতা ও মানসিক সমস্যা: বায়ু দূষণের কারণে মানুষের শরীরে নানা রোগ বালাই বাসা বাধছে। তেমনি মনের উপর ভীষণ চাপ বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়ছে মানুষের বিষন্নতা। বাড়ছে রাগ, ক্ষোভ ও মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা। সব মিলিয়ে বায়ু দূষণের কারণে মানুষের মধ্যে আজ হতাশার প্রবনতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে বলে গবেষকদের কাছ থেকে জানা গেছে। যুক্তরাজ্যের ‘কিংস কলেজ’ ও ‘ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে’র পাঁচ বিশেষজ্ঞদের এসব কথা উঠে এসেছে।
গবেষনায় জানা গেছে, যে সব মানুষ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে আসে, তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ বেশি মানুষ বিষন্নতায় ভোগে। আর এসব মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আমাদের দেশে ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য জরিপে ও গবেষনায় প্রায়ই একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। বায়ু দূষণের সঙ্গে বিষন্নতা, রাগ, উদ্বেগ, খিটমিটে মেজাজ ও আত্মহত্যার সম্পর্ক শীর্ষক এই গবেষনায় ১৬ টি দেশের বায়ু সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই গবেষনার ফলাফল বাংলাদেশে খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ কোনো শহরের বায়ুদূষণ যে মাত্রায় থাকলে বিষন্নতা ও আত্মহত্যা বাড়ে, বাংলাদেশে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, গাজীপুরসহ বড় শহর গুলোতে সে ধরনের দূষিত বায়ু রয়েছে। বছরের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে এ ধরনের বায়ু থাকায় এখানেরও একই ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়ার কথা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে ২০১৮-১৯ অনুযায়ী দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ১৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। এসব ব্যক্তির ৯২ শতাংশ চিকিৎসা নেন না। ৭ থেকে ১৭ বছর বয়সী ১৪ শতাংশ কিশোর কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আছে। জানা গেছে, মানুষ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে এলে তা নিশ্বাসের সঙ্গে দেহের ভেতরে ও রক্তে প্রবেশ করে। এতে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় ও স্নায়ু গুলো কাজ করে না। অনেকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারেনা। আবার অস্থিরতাও সৃষ্টি হয়। ফলে তারা বিষন্নতা সহ নানা মানসিক সমস্যায় ভুগতে থাকে। এদের অনেকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে আত্মহত্যা করে থাকে।
বায়ু দূষণে সবচেয়ে ক্ষতি যেখানে: বায়ু দূষণের ভয়াবহতা জানা সত্ত্বেও আমরা হরহামেশাই দূষিত করছি এই মহা মূল্যবান দান। শিল্পকারখানা অবকাঠামো নির্মাণ, জৈবজ্বালানী, যানবাহনের ধোয়া, ইটভাটার জ্বালানীর কারণে বাতাসে মিশে যাচ্ছে জীবদেহের জন্য ক্ষতিকারক ধুলিকনা, কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেন, সিসা, কার্বন মনো অক্সাইডের মতো মারাত্মক সব গ্যাস। বায়ু দূষণের কারণে বিশ্ব জুড়ে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। আর বাংলাদেশের প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ এই বিষাক্ত বাতাস।
১) ইটভাটা ও যানবাহন: আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার ইটভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটায় বছরে প্রায় ২০ লাখ টন জ্বালানী কাঠ ও ২০ লাখ টন কয়লা ব্যবহৃত হয়। এই বিপুল পরিমাণ জৈব জ্বালানী থেকে বাতাস বিষাক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড এবং বছরে প্রায় ৯০ লাখ টন গ্রিন হাউস গ্যাস বায়ু মন্ডলে মিশে যাচ্ছে। ইটভাটাগুলো নির্ধারিত উচ্চতা মেনে না চলার কারনে আশপাশের পরিবেশের বিপর্যয়, কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি মানুষ শ্বাষকষ্ট, হৃদরোগ, ফুসফুসে ক্যানসার সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের শহরগুলো বিশেষ করে গাজীপুর, নারায়নগঞ্জ ও ঢাকার বাতাসে বিভিন্ন গ্যাস মিশে দূষণ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকায় প্রায় ১ কোটি মানুষের বসবাস। তাদের আবাসস্থলের জন্য, দালানকোঠা নির্মাণের কারণে যে অল্পকিছু গাছ ছিল, সেগুলোও দ্রুত কমে যাচ্ছে। এছাড়া অতিরিক্ত জ্বালানী ব্যবহার, যানবাহনের কালো ধোয়া, শিল্পকারখানার বিষাক্ত ধোয়া সর্বোপরি নির্মানাধীন অবকাঠামো থেকে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
এক তথ্যে জানা গেছে, সারাদেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ীর সংখ্যা ৪ লাখ ৫৮ হাজার এবং ঢাকাতেই এসব গাড়ীর সংখ্যা ১ লাখ ৫৮ হাজার। ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ীর কালো ধোয়ায় রাজধানী ঢাকা সহ নারায়নগঞ্জের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। শুধু ধূলিকণা নয়, ঢাকার বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্যাডামিয়াম, সিসা, ম্যাঙ্গানিজের মতো বিষাক্ত কণার পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি। যার জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে নগরবাসী। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা। বায়ু মন্ডলের অন্যতম ক্ষতিকারক উপাদান পিএম ২.৫ এর মাত্রা বাড়ার কারণে শিশুরা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া বায়ু দূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি, এ্যজমা ও ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি বেশি। তাছাড়া প্রয়োজনীয় গাছপালার অভাবে ঢাকার বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমান ৩৫০ পিপিএমের উপরে। যেখানে বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য ২৯০-৩০০ পিপিএমের বেশি থাকা উচিৎ নয়। একদিকে বাতাসে বাতাসে ক্ষতিকর গ্যাস ও ধূলিকণা বায়ুমন্ডলে মিশে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বৃদ্ধি করছে।
২) প্লাস্টিক বর্জ্য: খাবার থেকে শুরু করে ঔষধ, প্রসাধনী সামগ্রী অথবা প্রযুক্তিপণ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ ব্যবহার করছে বায়ুদূষণকারী প্লাষ্টিক। যা সমুদ্র ও প্রকৃতি দূষণে মারাত্মক দায়ী। স্থায়ীত্ব, কম খরচ এবং বিভিন্ন আকার ও এর সহজলভ্যতার কারণেই প্লাষ্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। প্লাষ্টিক অপচনশীল রাসায়নিক দ্রব্য, যা পরিবেশে সহজেই মেশে না। তাই বায়ুর ওপর প্লাষ্টিকের নৈতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। ব্যবহৃত প্লাষ্টিক যখন আমরা যেখানে সেখানে ফেলে দিই, তখন সেই প্লাষ্টিক চলে যায় ড্রেন, খাল-বিল, নদী-নালা এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে সমুদ্র। ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপর ফেলছে মারাত্মক প্রভাব, ছড়াচ্ছে রোগ-জীবানু।
সাম্প্রতিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৩ মিলিয়ন প্লাষ্টিক প্রতি বছর নদী ও সাগরে পতিত হওয়ার ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের তুলনায় প্লাষ্টিকের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। আরেক হিসাবে বলা হয়েছে, বিশ্ব জুড়ে প্রতি মিনিটে ৩৩ হাজার ৮০০ টি বোতল ও ব্যাগ সাগরে গিয়ে পড়ছে। বছরে যার পরিমাণ ৮০ লাখ টন, যা জলজ প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ। বেসরকারী সংস্থা ওয়েষ্ট কনসার্নের এক প্রতিবেদন তথ্যে বলা হয়েছে যে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু ৩.৫ কেজি প্লাষ্টিক ব্যবহার করছে।
পরিবেশ ও বায়ুদূষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘অফ ডে’ নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে প্লাষ্টিক দূষণে বাংলাদেশ দশম। আমাদের দেশের বর্জ্যরে প্রায় ৮ শতাংশ প্লাষ্টিক। শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিব্যাগ পরিত্যক্ত হয়। সুতরাং সারাদেশে পলিথিনের ব্যবহার অনুমান করা সহজ বিষয়। বর্তমান ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ প্লাষ্টিক বর্জ্য। বর্তমান পলিথিন প্লাষ্টিক কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার। প্লাষ্টিক কারখানায় প্রতি বছরে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহৃত হয়। ১ কেজি প্লাষ্টিক উৎপাদনে ২ থেকে ৩ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ানো ও বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। প্লাষ্টিকের বর্জ্যে আচ্ছাদিত পানির মাছ খেলেই ক্যানসারের মতো দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
মেডিকেল বর্জ্য: মেডিকেল বর্জ্যের বিষাক্ততা আমাদের সমাজ জীবনে নানা রকম দূষণের সৃষ্টি করে। কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন নির্দেশনা থাকলেও তোয়াক্কা করা হয়না। পতিত বর্জ্য হতে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষা ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগ ছড়াতে পারে। আর ব্যবহৃত দূষিত সিরিঞ্জ হতে এইডস ও সংক্রমিত হবার ঝুকি থাকে। তবে কেবল স্বাস্থ্যঝুকি নয়, উন্মুক্ত স্থানের বর্জ্য প্রাকৃতিক পরিবেশের ও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষ্যমতে মেডিকেল বর্জ্যরে উন্মুক্ত ভাগাড়, পানীয় জল এবং ভ’ উপরিভাগের জলাধার গুলোকেও দূষিত করতে থাকে।
বলা দরকার যে, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। ইহার মধ্যে ৫০ টন আসে হাস্পাতাল ও ক্লিনিক হতে। আর এই বর্জ্যরে মাত্র ৮ শতাংশ রয়েছে যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী সারাদেশে সরকারী স্বাস্থ্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আছে ২ হাজার ২৩৫ টিরও বেশি। তার মধ্যে চালু রয়েছে আরো প্রায় ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক। এ ধরনের ১৮ হাজার ক্লিনিক চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এর বাইরে আরো বেসরকারী খাতে নিবন্ধিত হাস্পাতাল ও ক্লিনিক আছে ৩ হাজার ৪১৬ টি। বেসরকারী ডায়াগনষ্টিক সেন্টার বা প্যাথলজিক্যাল সেন্টার রয়েছে ৬ হাজারের বেশি। শুধু রাজধানীতেই ১ হাজার ২০০ ছোট-বড় হাস্পাতাল, ক্লিনিক রয়েছে। এসব হাস্পাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার থেকে যে পরিমান কেমিক্যাল বর্জ্য ফেলা হয়, সেটা যথাযথভাবে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা হচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন সবার!
বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকারী বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ওয়েষ্ট কর্নসানের গবেষনা হতে জানা যায় যে, ২০০৭ সালে সমগ্র দেশে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গুলোতে উৎপন্ন বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল ১২ হাজার টনের বেশি। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাড়ায় সাড়ে ১৯ হাজার টন। ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাড়ায় সাড়ে ২১ হাজার টন। পরিবেশ আইনে যদিও রয়েছে যে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার স্থাপনের পূর্বে নিজস্ব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে রাখা। যার কিছুই বর্তমান হচ্ছে না। যার ফলে বিষাক্ত মেডিকেল বর্জ্য দিন দিন বাড়ার কিছুই বর্তমানে হচ্ছেনা। যার ফলে বিষাক্ত মেডিকেল বর্জ্য দিন দিন বাড়ার সাথে সাথে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ছে। আর ছিন্নমূল শিশু ও টোকাই শিশুরা মারাত্মকভাবে এর শিকার হচ্ছে। তাদের রোগাক্রান্ত জীবানু সমাজের সব শ্রেনীর মানুষ ও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
শব্দ দূষণ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে মানুষের শব্দ গ্রহনের স্বাভাবিক মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিভাগীয় শহর গুলোর শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবল ছাড়িয়ে গেছে। যা স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আড়াই থেকে ৩ গুন বেশি। এছাড়া বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে রাজধানী ঢাকা বেশ আগ থেকে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় চলে গেছে। এখানে সুস্থ্য থাকার মতো কোনকিছুই নিয়ন্ত্রণে নেই। হাইড্রোলিক হর্ন অনেক আগেই আইনগত নিষেধ থাকলে তা রীতি চলছে। কিন্তু এই হর্ন মানব জীবনের জন্য কত ক্ষতিকর তা জানারও প্রয়োজন মনে করা হয়না। মাত্রাতিরোক্ত শব্দের দূষণে ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ১২% মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে উঠে এসেছে। সেই সাথে মানব দেহে যোগ হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ ফুসফুসের জটিলতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্মরনশক্তি হ্রাস পাওয়া, মানসিক চাপসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে প্রশাসনের নাকের ডগায় গাড়ীর হর্ন বাজলেও সেখানে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এসব দায় সাধারণ মানুষের ওপর পড়ছে। দূষণের কারনে প্রতি বছর মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করছে অথবা শ্রবন প্রতিবন্ধিসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
করণীয়:
১. ইটভাটাগুলো আইনের আওতায় আনা এবং অনুমতিহীন সকল ডাটা বন্ধ করা।
২. ফিটনেসবিহীন যানবাহন বিআরটিসির মাধ্যমে বন্ধ করা এবং কালো ধোয়া থেকে নিরাপদে থাকা।
৩. শহরভিত্তিক সবুজায়নে জোর দেওয়া।
৪. রাজধানীসহ জেলা শহর গুলোর খাল দখলমুক্ত করে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাখার কার্যকরী ব্যবস্থা করা।
৫. খোলা ড্রেন এবং যত্রতত্র ময়লা আবর্জনামুক্ত শহর ঘোষনা করা।
৬. মেডিকেল বর্জ্য ও প্লাষ্টিক বর্জ্যরে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা।
৭. হাইড্রোলিক হর্ন পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষনা করা।
৮. দালানকোঠা নির্মান ও রাস্তা সংস্কারের জন্য সমন্বিত নীতিমালা নির্দেশ ও বাস্তবায়ন করা।
৯. বিভিন্ন কোম্পানির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য রাস্তা খোড়াখুড়ির ব্যাপারটি সাবধানে কাজ করা।
১০. কলকারখানার জন্য কার্বনট্যাক্স বসানো।
১১. বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া।
১২. কন্সট্রাকশনের কাজে নিয়মনীতি ও সময় বেধে দেয়া।
১৩. সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
১৪. ভেজাল পণ্য সামগ্রী সরবরাহের নিষেধাজ্ঞা ব্যবস্থাপনা জোরদার করা।
১৫. সংশ্লিষ্ট সিটিকর্পোরেশন ও শহর পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর দেয়া।
১৬. ট্যানারী বর্জ্য সংরক্ষনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা।
সর্বোপরি দূষণের কোনো শেষ নেই। জীবন চলার পথে সব জায়গায় দূষণের মারাত্মক বিষাক্ততা ছড়াচ্ছে অবলীলায়। যার ফলে নতুন নতুন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার আশারূপ সুযোগ সুবিধা না পেয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে রুগিরা। দেশের অর্থ ব্যয় করে সর্বশান্ত হচ্ছে অনেক পরিবার। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব সহ অন্যান্য দেশে যাচ্ছে এসব অভিভাবক রুগি। একদিকে দেশের অর্থ যেমন ব্যয় হচ্ছে, অপরপক্ষে প্রতি বছর নানা জটিল রোগের প্রাদুর্ভাব আকাশ-বাতাস ভারী হচ্ছে। দেশে প্রতিরোধমূলক অনেক নীতিমালা থাকা সত্ত্বেও তার বাস্তবায়ন হয় না। এভাবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। অনেক এনজিও দেশের এহেন পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে এলেও প্রশাসনের সদিচ্ছা না থাকায় দেশের বায়ু দূষণের ধারা ও গতি আরো কঠিন ও জটিল হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রতিকার ও প্রতিরোধের কৌশল অবলম্বন করা এখন সময়ের অনিবার্য দাবি। যে হারে নানাভাবে বায়ু দূষণের প্রভাব জনস্বাস্থ্যের উপর বর্তাচ্ছে। সুস্থতার আশায়, মানুষের কল্যান কামনা করে অবস্থা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহনের এখনই সময়!
লেখক: আবুল কালাম আজাদ
কলেজ অধ্যক্ষ, গবেষক ও কলামিস্ট।