1. Home
  2. আইন-আদালত
  3. আইন ও জীবন
  4. শ্রমিকের আর্তচিৎকার রোধকল্পে জনসচেতনতার গুরুত্ব
শ্রমিকের আর্তচিৎকার রোধকল্পে জনসচেতনতার গুরুত্ব

শ্রমিকের আর্তচিৎকার রোধকল্পে জনসচেতনতার গুরুত্ব

0
  • 1 month ago,

অ্যাডভোকেট আইরিন আক্তার

শ্রমিক দিবসের ইতিহাস বলতে গেলে বলতে হয় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের ম্যাসাকার দিয়ে, ঐদিন শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞতা নামার বোমা নিক্ষেপের পর, পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। এর ফলে ১০-১২ জন পুলিশ শ্রমিক নিহত হয়।

১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে, প্যারিসে আন্তর্জাতিক প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিকাগোতে যে প্রতিবাদ হয় তা আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক দ্বিতীয় কংগ্রেসের এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর পরপরই ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। পরে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারড্যাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মিছিল ও শোভা যাত্রার আয়োজন করতে বলা হয় সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংঘকে । ঐদিন মিছিলে কোন হতাহত হয়নি। এবং বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংঘ মে মাসের ১ তারিখে বাধ্যতামূলক কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অনেক দেশ পহেলা মে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালনের দাবি জানায়, অনেক দেশেই এটা কার্যকর হয়।

শ্রমিক দিবস কার্যকর হলেও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা এখনও সম্ভব হয়নি। তাই শ্রমিকের আর্তচিৎকার রোধকল্পে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কাজ করতে হবে। মালিকের বিবেকে কড়া নাড়ে এমন আইন বাস্তবায়ন করে, এবং শ্রমিকের মুখের হাসি ক্রয় করা বিশ্বের আন্তর্জাতিক মহলের দাবিকে সক্রিয় করা উচিত।

শ্রমিক তার শ্রম বিক্রয় করে- অনুগ্রহ ক্রয় করতে নয় বরং তারা তাদের শ্রম বিক্রয় করে অধিকার নিশ্চিত করতে। এটা বুঝতে হবে নিম্নমনা মালিকদের। মালিক তার অধিকার বুঝে নিবে এবং শ্রমিক তার অধিকার বুঝে নিবে এমনটি হলে ইতিহাস বদলে যাবে শ্রম দিবসের মানে অর্জন হবে।
শ্রমিক এবং শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা যায় তাদের সুযোগ সুবিধা পূরণ করে । চা শ্রমিক, ইটভাটার শ্রমিক, কয়লা খনির শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক,কন্সট্রাকশন শ্রমিক,,আরো হাজারো সেক্টরের শ্রমিক, তারা কি শ্রম অনুযায়ী তাদের অধিকার, সম্মান নিশ্চিত করতে পেরেছে? এত আন্দোলনের পরেও বেশি ডিউটি করে এবং সময় মত বেতন পান না। শ্রম অনুপাতে মূল্য পান না। শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রত্যেক সেক্টরের লিডারদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। তবেই শ্রমিক এর শ্রম সার্থক হবে।

বিভিন্ন সেক্টরে মহিলারা কাজ করেন তাদের ছোট বাচ্চারা বাসায় থাকেন। এতে উনাদের শারীরিক শ্রমের সাথে মানসিক প্রেসার বাড়ে। কাজে মনোযোগিতা হারায়। এর ফলে প্রভাব পড়ে উৎপাদনে। সুতরাং কর্মস্থলে যদি বাচ্চাদের রাখার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে একজন মা শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা যাবে কিঞ্চিত হলেও।
মালিকের উচ্চ আকাঙ্ক্ষায় গতি রোধ এবং বিবেক জাগ্রত করতে পারলে শ্রমিকদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা সম্ভব হবে। মালিকের উচ্চ চাহিদার কারণে নিম্ন শ্রেণীর শ্রমিক যথা ইট ভাটার শ্রমিক, কয়লা খনি শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে যায। কোন নিয়ম বা রুলস না থাকার কারণে শারীরিক অক্ষমতা হতে পারে,মানসিক দুর্গতিও হতে পারে ক্ষেত্রবিশেষে।
মালিক শ্রমিকের বৈষম্য রোধ এবং সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হলে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে হবে। এছাড়াও পছন্দমত ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের সুযোগ হবে শ্রমিকদের। যাতে করে তারা তাদের সুবিধা ও অসুবিধার বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে পারেন। এবং তা বাস্তবায়নকল্পে কাজ করেন উভয়ই।


পাওয়া পরিশোধের তৎপর হয়ে শ্রমিকদের অধিকার অক্ষুন্ন রাখা যায় কীভাবে, সে বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম লাভ করবে এবং সে অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়া তার অধিকার। শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করতে সদা সতর্ক থাকতে হবে মালিক মহলকে। বিভিন্ন ইন্সুরেন্সের ব্যবস্থা থাকতে হবে। দুর্ঘটনা যেন শ্রমিকের জীবনকে স্থবির করে দিতে না পারে, সেজন্য তাদের একটা এমাউন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মালিক শ্রমিক উভয়েই যদি আইন মেনে কাজ করেন তাহলে, তাদের অধিকার নিয়ে আর চিৎকার করতে হবে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে শ্রমিকদের জন্য কী ধরনের আইনগত অধিকার ও সুরক্ষা রয়েছে তা পর্যায়ক্রমে বলা হলো।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার এ বিষয়টি স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ঘোষণাপত্রের ধারা ২৩ বলা হয়েছে:

১। প্রত্যেকেরই চাকরি বেছে নেওয়ার, কাজের ন্যায্য মূল্য পাবার, এবং অনুকূল পরিবেশ পাবার অধিকার রয়েছে। ২। বৈষম্য ছাড়া সমান কাজের জন্য সমান বেতন পাবার অধিকার রয়েছে। ২৪ ধারায় বলা হয়েছে প্রত্যেকেরই বিশ্রাম ও অবসরের অধিকার রয়েছে
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধানে শ্রমিক শ্রেণীর সুরক্ষার বিষয়টি যোগ করা হয়েছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪ তে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হবে মেহেনতি মানুষকে অর্থাৎ কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে শোষণ থেকে মুক্তি দান করা। সংবিধানে আরো বলা হয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা থাকবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৪ বলা হয়েছে। জোর জবরদস্তি মূলক শ্রম নিষিদ্ধ কোনভাবে এটা লংঘন করা হলে তা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
শ্রমিকদের আইনগত সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশে ২০০৬ সালে শ্রম আইন পাস করা হয়েছে। একই সাথে আইনকে কার্যকর করার জন্য ২০১৫ সালে শ্রম বিধিমালা অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়াও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন ২০০৬ পাশ ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বিধিমালা ২০১০ অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এসব আইন প্রয়োগের লক্ষ্যে শ্রম আদালত ও শ্রমও আপিল আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
শ্রমিকদের আইনগত অধিকার রক্ষার জন্য আইনে যে সমস্ত বিষয় বলা আছে। ধারা ৫ ও ৬ বলা আছে, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের স্বীকৃত অধিকারসমূহের মধ্যে রয়েছে মালিক কর্তৃক নিয়োগ পত্র পরিচয়পত্র এবং নাম ঠিকানা যোগদানের তারিখ ইত্যাদি তথ্যসম্বলিত সার্ভিস বইয়ের ব্যবস্থা করতে।

ধারা ১০০ ও ১০২ তে বলা আছে, শ্রমিকের কর্ম ঘন্টা হবে দৈনিক ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে হবে ৪৮ ঘন্টা অতিরিক্ত কাজ করালে একজন শ্রমিককে দৈনিক সর্বোচ্চ ১০ ঘন্টা কাজ করানো যাবে। ছুটি একজন শ্রমিকের গুরুত্বপূর্ণ আইনগত অধিকার। ধারা ১১৮ কে বলা আছে, সপ্তাহে পূর্ণ একদিন ছুটি পাবেন এবং বছরে কমপক্ষে ১১ দিন বেতনসহ উৎসব ছুটি পাবেন। ধারা ১১ তে বলা আছে, চাকরি থেকে অবসর ছাঁটাই ডিসচার্জ অবসান কালে ছুটি পাওনা থাকলে শ্রমিকদের ছুটির মজুরি প্রাপ্য হবেন। ধারা ২৯-৩০ এ বলা আছে কোন শ্রমিক যদি ভবিষ্যৎ তহবিলের সদস্য হন তাহলে তার চাকরির অবসনকালে তহবিল থেকে ৩০ দিনের মধ্যে তা ফেরত পাবেন। নারী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ সুবিধা আছে এই আইনে। ১০৯ ধারায় বলা হয়েছে কোন নারীকে বিনা অনুমতিতে রাত দশটা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কোন কাজ করতে দেয়া যাবে না। ধারা ৪৬ বলা হয়েছে, নারী শ্রমিক প্রসূতিককালীন ছুটি পাবেন ছয় মাস। ধারা ৫১ও ৬০ বলা আছে সুস্থ কর্ম ও পরিবেশ সম্পর্কে। ধারা ৮৯ ও ৯২ও ৯৪ এ বলা আছে প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা ক্যান্টিন ও শিশু কক্ষের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ধারা ১৫০ ও ১৫১ তে বলা আছে দুর্ঘটনা রোধ ও ক্ষতিপূরণ বিষয়ে। সেখানে বলা আছে কারখানায় দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। ভবন ও যন্ত্রপাতির নিরাপত্তা সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন নিরাপত্তা বিপদজনক ধোয়াসহ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের নিরাপদ ব্যবস্থা থাকতে হবে চাকরি চলাকালে দুর্ঘটনার শিকার হলে মালিক কে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য শুধু জনসচেতনতা বাড়ালেই হবে না । শ্রমিক কেউ সচেতন হতে হবে তার অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য। মালিক মহলকেও নৈতিক দায়িত্ব মনে করতে হবে শ্রমিকের অধিকার দেওয়ার ব্যাপারে। তবেই বৈষম্য রক্ষা হবে। শ্রমিক দিবসের লক্ষ্য অর্জন হবে।

লেখক: আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা

নিউজ টুডে বিডি/ঢাকা