
গাজায় সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা বেড়ে ২৩৭
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৭ জনে। সর্বশেষ গতরাতে বিমান হামলায় গাজা সিটিতে আল জাজিরার পুরো সংবাদকর্মী দলকে (৬ জন) হত্যা করেছে । নিহতরা হলেন ১/ আনাস আল-শরীফ (প্রতিবেদক), মোহাম্মদ কুরাইকা (প্রতিবেদক), ইব্রাহিম জাহের (ক্যামেরাম্যান), মোয়ামেন আলাইওয়া (ক্যামেরাম্যান), মোহাম্মদ আল খালিদি (ক্যামেরাম্যান) ও মোহাম্মদ নোফাল (দলের ড্রাইভার) ।
গাজার শিফা হাসপাতালে সাংবাদিকদের তাঁবুতে ইসরায়েলি হামলায় আল জাজিরার সাংবাদিক আনাস আল-শরিফ নিহত। ইসরায়েল পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে হত্যা করেছে। হত্যার পর আবার তারা স্বীকারোক্তি দিয়ে আপডেটও দিয়েছে।
আল জাজিরা সাংবাদিক আনাস আল-শরীফের শেষ বার্তা
“এটাই আমার উইল এবং শেষ বার্তা। যদি আমার এই কথাগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছে, তবে জেনে রেখো—ইসরায়েল আমাকে হত্যা করে আমার কণ্ঠ স্তব্ধ করতে সফল হয়েছে। আল্লাহর শান্তি, রহমত ও বরকত তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক।
আল্লাহ জানেন, আমি আমার সর্বোচ্চ শক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে আমার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি এবং তাদের কণ্ঠ হয়েছি—যেদিন আমি চোখ খুলেছি গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের গলিপথে, সেদিন থেকে শুরু করে।
আমার আশা ছিল আল্লাহ আমার জীবন দীর্ঘ করবেন, যাতে আমি আমার পরিবার ও প্রিয়জনদের নিয়ে আমাদের মূল শহর, দখলকৃত আসকালন “মাজদাল”-এ ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকর হয়েছে, তাঁর ফয়সালা পূর্ণ হয়েছে।
আমি জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটিতে কষ্ট ভোগ করেছি, বারবার হারানো ও শোকের স্বাদ পেয়েছি। তবুও আমি একদিনের জন্যও সত্যকে বিকৃত না করে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থেকে পিছু হটিনি — আশা করেছি আল্লাহ সাক্ষী হবেন তাদের বিরুদ্ধে যারা নীরব থেকেছে, যারা আমাদের হত্যাকে মেনে নিয়েছে, যারা আমাদের নিশ্বাসকে অবরুদ্ধ করেছে, শিশু ও নারীদের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে নীরব থেকেছে, এবং যারা আমাদের জনগণের ওপর দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা গণহত্যা থামায়নি।
আমি তোমাদের হাতে অর্পণ করছি ফিলিস্তিনকে—যা মুসলিম উম্মাহর মুকুটের হীরা, বিশ্বের প্রতিটি স্বাধীন মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন।
আমি তোমাদের হাতে অর্পণ করছি এর জনগণকে, সেই নির্যাতিত শিশুদের যাদের স্বপ্ন দেখার বা নিরাপদে বাঁচার সুযোগ দেওয়া হয়নি, যাদের নিষ্পাপ দেহ হাজার হাজার টন ইসরায়েলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে, ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ দেয়ালে ছড়িয়ে পড়েছে।
আমি তোমাদের অনুরোধ করছি—শৃঙ্খল যেন তোমাদের নীরব না করে, সীমান্ত যেন তোমাদের আটকাতে না পারে। ভূমি ও জনগণের মুক্তির সেতু হয়ে দাঁড়াও—যতক্ষণ না মর্যাদা ও স্বাধীনতার সূর্য আমাদের লুণ্ঠিত মাতৃভূমির আকাশে উদিত হয়।
আমি আমার পরিবারকে তোমাদের হাতে সঁপে দিচ্ছি—
আমার প্রাণের টুকরা, প্রিয় কন্যা শাম, যাকে আমি স্বপ্নের মতো বড় হতে দেখতে পারিনি।
আমার প্রিয় ছেলে সালাহ, যাকে আমি শক্তিশালী হওয়া পর্যন্ত পাশে থেকে সমর্থন দিতে চেয়েছিলাম, যাতে সে আমার দায়িত্ব বহন করে মিশন চালিয়ে যেতে পারে।
আমার প্রিয় মা—যার দোয়া আমাকে এই অবস্থায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। তাঁর দোয়া ছিল আমার দুর্গ, তাঁর আলো ছিল আমার পথপ্রদর্শক। আমি প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাঁর হৃদয়কে ধৈর্য দেন এবং তাঁকে উত্তম প্রতিদান দেন।
আমার আজীবনের সঙ্গিনী, প্রিয় স্ত্রী উম্মে সালাহ বায়ান—যাকে যুদ্ধ দীর্ঘদিন ও মাসের পর মাস আমার থেকে আলাদা করেছে, তবুও তিনি ছিলেন অবিচল জলপাই গাছের কাণ্ডের মতো দৃঢ়, ধৈর্যশীলা, আল্লাহর ওপর ভরসাকারী, আমার অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন পূর্ণ শক্তি ও ঈমানের সাথে। আমি তোমাদের অনুরোধ করছি—তোমরা তাঁদের পাশে থেকো, আল্লাহর পরে তাঁদের সহায় হও।
যদি আমি মারা যাই, আমি আমার নীতিতে অটল থেকেই মরব—আল্লাহর সামনে সাক্ষ্য দেব যে আমি তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্ট, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে প্রস্তুত এবং নিশ্চিত যে আল্লাহর কাছে যা আছে তা-ই উত্তম ও চিরস্থায়ী।
হে আল্লাহ, আমাকে শহীদদের অন্তর্ভুক্ত করো, আমার অতীত ও ভবিষ্যতের সব গুনাহ মাফ করো, আমার রক্তকে আমার জনগণ ও পরিবারের জন্য স্বাধীনতার পথে আলো বানাও। যদি কোনো ত্রুটি থেকে থাকে, আমাকে ক্ষমা করো এবং আমার জন্য রহমতের দোয়া করো—কারণ আমি আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করেছি, বদলাইনি, নড়বড়ে হইনি।
গাজাকে ভুলে যেও না…
আমাকে ভুলে যেও না—তোমাদের ক্ষমা ও কবুলের দোয়ার মধ্যে।”
আনাস জামাল আল-শরীফ
০৬.০৪.২০২৫