মসজিদ তৈরির উদ্দেশ্য হলো, সেখানে ছালাত আদায়, আল্লাহর যিকির, কুরআন তেলাওয়াত ও দ্বীনের আলোচনা করা। মসজিদগুলোতে একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করতে হবে এবং তাঁর সাথে অন্য কারো ইবাদাত করা চলবে না। যেমন— ইয়াহূদী ও নাছারারা তাদের উপাসনালয়ে শিরক করে থাকে। অন্যদিকে ভ্রান্ত আক্বীদা-বিশ্বাস, মিথ্যা কর্মকাণ্ড এবং বিদআতী আলোচনা থেকেও মসজিদকে মুক্ত রাখতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মসজিদসমূহ আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকেও ডেকো না’ (আল-জিন, ৭২/১৮)। অর্থাৎ পৃথিবীর কোথাও যেন শিরকী কর্মকাণ্ড না হয়, এটা আল্লাহর ইচ্ছা। জুনদুব রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সাবধান! তোমাদের আগে যারা ছিল (ইয়াহূদী ও নাছারা) তারা তাদের নবী ও নেক্কার লোকদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। ‘সাবধান! তোমরা কবরসমূহকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ হতে নিশ্চিতভাবে নিষেধ করছি’। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার জন্য সমগ্র পৃথিবীকে মসজিদ এবং পবিত্রতা অর্জনের উপায় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে’। অন্যত্র রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ‘আল্লাহর নিকট সকল জায়গা হতে মসজিদই হলো সবচেয়ে প্রিয় স্থান, আর বাজার হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান’।
মসজিদ নির্মাণের গুরুত্ব ও ফযীলত : মসজিদ নির্মাণের গুরুত্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যেসব গৃহকে সমুন্নত করতে এবং সেগুলোতে তাঁর নাম স্মরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে’ (আন-নূর, ২৪/৩৬)। এখানে গৃহ বলতে মসজিদ আর সমুন্নত করা বলতে নির্মাণ করা ও মর্যাদা প্রদান উদ্দেশ্য।
মসজিদ নির্মাণকারীর শ্রেষ্ঠত্ব : উমার ইবনুল খাত্ত্বাব রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর নামে যিকিরের জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি তৈরি করবেন’। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য টিড্ডির ঢিবির ন্যায় বা তার চাইতেও ক্ষুদ্র একটি মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করবেন’।
উক্ত হাদীছে মসজিদ নির্মাণের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অন্যথা টিড্ডির বাসার ন্যায় ঘরে তো আর ছালাত আদায় করা সম্ভব নয়। মসজিদ হতে হবে সাদাসিধে এবং কারুকার্য মুক্ত। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ক্বিয়ামত ততক্ষণ আসবে না, যতক্ষণ না মানুষ মসজিদের সৌন্দর্য ও শোভাবদ্ধন নিয়ে পরস্পর গর্ব করবে’।
মসজিদে যাতায়াতকারীর শ্রেষ্ঠত্ব : বুরায়দা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যারা অন্ধকারে মসজিদে যায়, ক্বিয়ামতের দিনে তাদের পূর্ণ জ্যোতির সুসংবাদ দাও’। রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় মসজিদে উপস্থিত হয়, সকাল-সন্ধ্যার যখনই সে মসজিদে উপস্থিত হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি স্থান প্রস্তুত করেন’। অন্য হাদীছে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মসজিদে আগমনকারী ব্যক্তি আল্লাহর যিয়ারতকারী মেহমান, আর অতিথিসেবকের কর্তব্য হলো মেহমানের সম্মান করা’। আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সাত ধরনের মানুষকে আল্লাহ তাআলা ক্বিয়ামতের দিন তাঁর ছায়ার নিচে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে এক শ্রেণির লোক সে, যার অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকে। অর্থাৎ মসজিদ থেকে ছালাত আদায় করে বের হওয়ার পর আবার অন্য ছালাতে মসজিদে যাওয়ার জন্য তার মন উদগ্রীব থাকে’।
মসজিদে ছালাত আদায় করার ফযীলত : আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ঘরে বা বাজারে ছালাত আদায় করার চেয়ে মসজিদে জামাআতের সাথে ছালাত আদায় করার ছওয়াব ২৫ গুণ বেশি। তার কারণ হলো, কোনো ব্যক্তি ভালো করে ওযূ করে শুধু ছালাত আদায় করার জন্যই মসজিদে আসে। তার প্রতি ধাপের বিনিময়ে একটা মর্যাদা বেড়ে যায়, আর একটি পাপ মুছে যায়। যখন সে ছালাত আদায় করে, ফেরেশতাগণ সর্বদা তার জন্য ততক্ষণ দু‘আ করতে থাকে যতক্ষণ সে ছালাতে থাকে। ফেরেশতাগণ অনবরত বলতে থাকে হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো, হে আল্লাহ! তুমি তাকে দয়া করো। আর যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ ছালাতের জন্য অপক্ষো করতে থাকে, সে সময়টা সে ছালাতের মধ্যেই থাকে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, যখন কেউ মসজিদে গেল, আর ছালাতের জন্য সেখানে অবস্থান করল, তখন সে ছালাতেই রইল’।
মসজিদ দেখাশোনা বা তত্ত্বাবধায়কের গুণাগুণ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর মসজিদের আবাদ তো তারাই করবে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনে, ছালাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। আশা করা যায়, তারাই হবে সঠিক পথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত’ (আত-তওবা, ৯/১৮)।
মসজিদের আদবসমূহ :
(১) মসজিদে প্রবেশের ও বের হওয়ার দু‘আ পড়া : আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে, তখন সে যেন বলে, ‘আল্লাহুম্মাফতাহলী আবওয়াবা রহমাতিক’। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার জন্য তোমার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দাও’। আর যখন বের হবে, তখন যেন বলে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা মিং ফাযলিক’। অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি’।
(২) মসজিদে প্রবেশ করলে বসার পূর্বে দুই রাকআত ছালাত আদায় করা : আবূ ক্বতাদা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করে, তখন দুই রাকআত ছালাত আদায় করা ছাড়া যেন না বসে’।
(৩) মসজিদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা : আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাড়া-মহল্লায় মসজিদ নির্মাণ করতে এবং তা পরিষ্কার ও সুগন্ধিময় করে রাখতে আদেশ করেছেন’। আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মসজিদে থুথু ফেলা গুনাহ। আর তার ক্ষতিপূরণ হলো ঐ থুথু মাটিতে পুঁতে ফেলা (দূর করা)’। আবূ যার গিফারী রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আমার উম্মতের ভালো-মন্দ সকল আমল আমার কাছে উপস্থিত করা হলো। তখন আমি তাদের ভালো কাজগুলোর মধ্যে দেখতে পেলাম, রাস্তা হতে কষ্টদায়ক জিনিস দূর করা। আর মন্দ কাজগুলোর মধ্যে দেখতে পেলাম, মসজিদে ফেলে রাখা কফ যা পুঁতে ফেলা হয়নি’।
(৪) মসজিদে হারানো বস্তুর ঘোষণা দেওয়া নিষেধ : আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে শুনতে পাবে কেউ মসজিদে হারানো বস্তুর ঘোষণা করছে, তখন শ্রবণকারী যেন বলে, ‘আল্লাহ যেন তোমাকে তা আর ফিরিয়ে না দেন। কেননা মসজিদ এরূপ কাজের জন্য তৈরি করা হয়নি’।
(৫) মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করা নিষেধ : আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা কোনো ব্যক্তিকে মসজিদে ক্রয়-বিক্রয় করতে দেখলে বলবে, আল্লাহ তোমার ব্যবসাকে যেন লাভজনক না করেন’।
(৬) কাঁচা পেঁয়াজ, রসুন ও দুর্গন্ধ জিনিস খেয়ে মসজিদে যাওয়া নিষেধ : মুআবিয়া ইবনু কুররাহ রাহিমাহুল্লাহ হতে তার পিতা সূত্রে বর্ণিত, ‘রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি গাছ তথা (কাঁচা) পেঁয়াজ ও রসুন খেতে নিষেধ করেছেন। যে তা খাবে, সে যেন আমাদের মসজিদের কাছে না আসে। তিনি আরো বলেন, ‘যদি তোমাদের একান্তই খেতে হয়, তবে তা পাকিয়ে দুর্গন্ধ দূর করে খাও’। অতএব, বিড়ি-সিগারেট পান করে মসজিদে যাওয়া আরো কঠিনভাবে নিষিদ্ধ।
(৭) মসজিদে দণ্ড কার্যকর করা নিষেধ : হাকেম ইবনু হিযাম রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে ও তথায় কবিতা পাঠ ও হদ্দ (কৃত অপরাধের ইসলামে নির্ধারিত) শাস্তি কার্যকর করতে নিষেধ করেছেন’।
পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের উপর্যুক্ত আলোচনা মেনে আমল করা এবং মসজিদের আদবগুলো যথাযথভাবে পালন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দিন- আমীন!
লেখা: মাহবূবুর রহমান মাদানী, শিক্ষক, আল-জামি‘আহ আস-সালাফিয়্যাহ।
নিউজ টুডে বিডি/নিউজ ডেস্ক